বিশেষ কিছু: নরেন্দ্র মোদির ভুটার সফর

ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে দুই দিনের যে সফরে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সেটা ভারত ও ভুটানের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের একটা অংশ, যেখানে দুই দেশের নেতারাই তাদের মেয়াদের শুরুর দিকে একে অন্যের দেশ সফরকে অন্যতম অগ্রাধিকার জ্ঞান করে থাকেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শেরিং; তার পাল্টা সফরে গেলেন মোদি। আসলে ৭২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাংদেচ্ছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি উদ্বোধনের বিষয়টি চিন্তা করে সফরের সময় পেছানো হয়েছিল। দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি ঐতিহ্যগত ঘনিষ্ঠতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, যেটা আজকের পৃথিবীতে বিরল। সীমান্ত উন্মুক্ত, পররাষ্ট্রনীতিতে দুই দেশ পরস্পরের কাছাকাছি এবং আলোচনার ভিত্তিতে পরিচালিত, এবং সকল কৌশলগত ইস্যুতে নিয়মিত খোলামেলা যোগাযোগ বজায় রয়েছে, যেটা এই সম্পর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং যেটা বিগত বহু দশক ধরে বজায় রয়েছে। কৌশলগত ইস্যুতে ভারতকে সর্বোতভাবে সহায়তা করায় সেটা আন্তর্জাতিক মঞ্চ ও জাতিসংঘে ভারতের জন্য বিরাট অর্জনের কারণ হয়েছে। একইভাবে, ভারতের জন্য যেগুলো হুমকি, সেগুলোর বিরোধিতা করার ব্যাপারে ভুটানের নেতৃবৃন্দ কখনও পিছু হটেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৩ সালে সাবেক রাজা উলফা বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন; আবার সম্প্রতি দোকলাম উপত্যকায় চীনা সেনাদের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছে ভুটান। ভুটানের পরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য ভারতের সহায়তা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে উচ্চ রাজস্ব আয়ের জন্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে দিয়ে এরপর সেই বিদ্যুৎ আবার কিনে নেয়ার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটা পারস্পরিক উপকারের ভিত্তি তৈরি হয়েছে, যেটা দুই দেশের নেতারাই লালন করে এসেছেন এবং এটাকে মি মোদি ‘উদাহরণ সৃষ্টিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তবে, ভুটানের সাথে এই সম্পর্কটাকে নিজেদের প্রাপ্য হিসেবে নিলে ভুল করবে নয়াদিল্লী। বিগত কয়েক বছরে, ভারত তাদের বিদ্যুৎ ক্রয় নীতিতে হঠাৎ করে পরিবর্তন আনায়, এবং তাদের অনমনীয় মূল্য এবং ভুটানকে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হতে না দেয়ায়, এবং বাংলাদেশের মতো তৃতীয় দেশের সাথে বাণিজ্য করতে না দেয়ায় দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। এই ইস্যুগুলোকে এখন বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। আরেকটি উদ্বেগ যেটি মতপার্থক্য তৈরি করতে পারে, সেটা হলো – ভারতের সাথে অতি বেশি বাণিজ্য, পরিবহন এবং পর্যটনের কারণে ভুটানের পরিবেশ ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল গ্রুপের অধীনে ভুটানে মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট (এমভিএ) বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা ভারতের রয়েছে, সেটা ভুটান স্থগিত রেখেছে। একই সাথে ভারতীয় পর্যটকদের ভুটানে প্রবেশের জন্য যে শুল্কের প্রস্তাব ভুটান দিয়েছে, সেটাও দুই দেশের মধ্যে পার্থক্য বাড়াতে পারে। ভুটানের শিক্ষার্থীদের আগের প্রজন্ম ভারতের বাইরে কোথায় তাকায়নি, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণ ভুটানিজরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ কারণে সম্পর্কে মেরামতের অনেক কিছু রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো নয়াদিল্লীকে কৌশলগত অন্যান্য শক্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে যারা ভুটানকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের সফরের মাধ্যমে যেটা ফুটে উঠেছে। বিশ্বে যেখানে অসংখ্য উপায় প্রতিনিয়ত খুলে যাচ্ছে, সেখানে ভারত ও ভুটানের জন্য ভালো হবে যদি তারা একে অন্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলে।

No comments

Powered by Blogger.