মালয়েশিয়ায় নির্বাচন: ৬১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বুধবার

মালয়েশিয়ার একষট্টি বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বুধবার। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটিতে ১৪তম বারের মতো জাতীয় নির্বাচন ওইদিন। দিনটিকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এজন্য যে, সেখানে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য লড়াইয়ের মাঠে আছেন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। আর তার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার যুদ্ধে নেমেছেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার বলে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। নাজিব রাজাকের সামনে অপ্রত্যাশিত এক চ্যালেঞ্জ দাঁড় করে দিয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে বিরোধীরা মাঠ কাঁপিয়ে তুলছেন। নাজিব রাজাকের নেতৃত্বে রয়েছে বারিশান ন্যাশনাল (বিএন) জোট। জরিপে তাদের পারফরমেন্স দুর্বল। এক্ষেত্রে নির্বাচনে বড় কোনো হেরফের হলে নিজ দলের ভেতরে তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হতে পারে। যদি তিনি নির্বাচনে হেরে যান তাহলে তা হবে এক অধিকতর বিপর্যয়কর। আর এর মধ্যদিয়ে খতম ঘটবে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব। এমনকি একজন রাজনীতিক হিসেবেই তার পরিচয়ের ইতি ঘটতে পারে। বুধবার অনুষ্ঠেয় এই ভোটকে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যকার লড়াই হিসেবে দেখছেন না মালয়েশিয়ানরা। তারা এ ভোটকে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে একটি গণভোট হিসেবে। অনেক দিক বিবেচনা করে এসব কথা লিখেছে অনলাইন সিএনএন। পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নাজিব রাজাক। কিন্তু তাকে সমীহ করা যায় এমন পারফরমেন্স তিনি দেখাতে পারেননি। তার জোট পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করলেও তারা জনপ্রিয় ভোটের শতকরা মাত্র ৪৭ ভাগ ভোট পেয়েছিল। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এমন কথা কখনো শোনা যায়নি। এই দেশটি ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। তারপর থেকে কোনো ব্যত্যয় ছাড়াই নাজিবের জোট দেশ শাসন করেছে। এই জোটে এক সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি নাজিব রাজাকের গুরুও। এখন সময়ের প্রয়োজনে সেই গুরুই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছেন। এজন্যই বুধবারের নির্বাচনকে শুধু নাজিবের ভোট বলা যাচ্ছে না। কারণ, মালয়েশিয়ার সাবেক শক্তিশালী নেতা মাহাথির মোহাম্মদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের মাধ্যমে উৎখাত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। মাহাথির একটানা ২২ বছর দেশ শাসন করে অবসরে যান ২০০৩ সালে। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক ধার কমেনি। তার বয়স এখন ৯২ বছর। এই বয়সে এসে তিনি বিরোধী রাজনীতিকদের দলে ভিড়েছেন এবং সেসব মানুষের অংশীদার হয়েছেন, যারা তার রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় ছিলেন শপথ নেয়া শত্রু। এরমধ্যে প্রধান হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। মাহাথির মোহাম্মদ এক সময় দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে তাকে জেলে পুরেছিলেন। আনোয়ার ইব্রাহিম আবারো কমকামিতার জন্য জেলে রয়েছেন। তাই তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। তাই ফিরে তাকিয়েছেন তার ঘোরবিরোধী মাহাথির মোহাম্মদের দিকে। তিনি মাহাথির মোহাম্মদকে সমর্থন দিয়েছেন, যেন তিনি বিরোধী দলের হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন মাহাথির। তার রানিংমেট হিসেবে পাশে রয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজা। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমকে দেখা হয় সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিক হিসেবে। তাই তারা জনপ্রিয় ভোটের অনেকটাই অর্জনে সক্ষম হতে পারেন। যদি তাদের সেই মিরাকল বা জাদু কাজে দেয় তাহলে একজনের ব্যক্তিত্বে বা জাদুতেই ক্ষমতা হারাতে পারেন নাজিব। মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ ব্রিজেত ওয়েলসের হিসাবমতে, পার্লামেন্টে প্রবেশের দৌড়ে নাজিব রাজাক জনপ্রিয় ভোটের শতকরা মাত্র ১৬.৫ ভাগ ভোট পেতে পারেন। তবে অন্য বিশ্লেষকদের মতে, এই সংখ্যা এর থেকে কিছুটা বেশি। তারা মনে করেন নাজিব রাজাক জনপ্রিয় বা পপুলার ভোটের এক তৃতীয়াংশ পেতে পারেন। তবে বিরোধীদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হলো নির্বাচনী প্রচারণায় মাহাথির মোহাম্মদের ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া দেশটির ভুয়া নিউজ বিষয়ক আইনের অধীনে তদন্তের মুখে রয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ। এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। তার সামনে দাঁড়ানো নাজিব রাজাক। তিনি মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। রাজনীতি তার সঙ্গে মিশে আছে শুরু থেকে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। তার পিতা মারা যাওয়ার পর সেই আসনে নির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হন। ২৫ বছর বয়সে তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অধীনে উপপ্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যের দায়িত্ব নেন। পাহাং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন হন তখন তার বয়স ৩০ বছরও হয়নি। ১৯৮৬ সালে তার বয়স যখন ৩৩ বছর তখন তাকে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন মাহাথির। এরপর নিজের দল ও জাতীয় রাজনীতিতে তর তর করে তার উত্থান ঘটতেই থাকে। তিনি শিক্ষা ও প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। দলের এবং মাহাথিরের সমর্থনে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় ২০০৮ সালে। এরপর ৯ বছর তিনি ক্ষমতায়। এর মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে মালয়েশিয়ায়। তার চুল এখন বরফের মতো সাদা। তবে তার সামনে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত যে সমালোচনা তা হলো দুর্নীতির অভিযোগ। তিনি রাষ্ট্রীয় তহবিল ‘ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ’ (এএমডিবি) থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। দেশের মিডিয়ার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল মাহাথিরের। এসব মিডিয়ার বেশির ভাগ মালিক সরকারপন্থি অথবা মাহাথিরের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তি। অন্যদিকে নাজিব রাজাকের মিডিয়া বলতে হলো ইন্টারনেট ও সামাজিক মিডিয়া। কিন্তু জাতীয় মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে মাহাথির যে সুবিধা পেয়েছেন ততটা এ মাধ্যমে পাননি নাজিব। ফলে এ থেকে মাহাথির ও বর্তমানের বিরোধীরা নাজিব রাজাক ও তার বারিশান ন্যাশসনালের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সুবিধা পেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.