অসুস্থতার ছাপ মৃদু হাসি: জোর করে হাসপাতালে আনার অভিযোগ বিএনপির

মুক্ত পরিবেশ নয়, তবুও আড়াই ঘণ্টা চার দেয়ালের বাইরের দুনিয়া দেখলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা  সোয়া ১১টার ঘরে। কারাগারে যাওয়ার ৫৭ দিন পর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে বের করা হয় কালো কাচঘেরা একটি গাড়িতে করে। কারাগেট থেকে শাহবাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তাটুকু আগে থেকেই ফাঁকা করে রেখেছিল পুলিশ। বেলা সাড়ে ১১টা। কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে ভেঁপু বাজিয়ে তিন নম্বর গেট দিয়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে র‌্যাবের অগ্রবর্তী দল। পেছনে পেছনে পুলিশের দুইটি জিপ। সবশেষে কালো কাচঘেরা একটি গাড়ি। হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করে গাড়িটি দাঁড় করানো হয় কেবিন ব্লকের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের তিন নম্বর গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। অবশ্য বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে জোর করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
ওদিকে কেবিন ব্লকের সিঁড়ির গোড়ায় আগে থেকে রাখা হয়েছিল একটি হুইল চেয়ার। এক মিনিট পর গাড়িটি ঘুরিয়ে একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় নিয়ে দাঁড় করানো হয়। তারপর কেটে যায় আরো দুই মিনিট। কারারক্ষী, পুলিশ, ডিবি পুলিশের সদস্যরা কয়েক স্তরের ব্যারিকেডের মাধ্যমে ঘিরে রাখে সে গাড়ি। সাদা পোশাকধারী একজন কারা কর্মকর্তা গাড়ির দরোজায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। তারপর চশমা চোখে, কালো ফুল তোলা হালকা ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরিহিত খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। গাড়ি থেকে নেমেই সাংবাদিকদের ডাকে কয়েক সেকেন্ডের মতো তিনি ক্যামেরার দিকে তাকান। এ সময় তার চেহারায় অসুস্থতার ছাপ থাকলেও চাহনীতে ছিল অটুট মনোবলের প্রকাশ। গাড়ি থেকে নামার পরক্ষণেই মহিলা পুলিশ ও কয়েকজন মহিলা কারারক্ষী তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়।
এ সময় তাকে জানানো হয়, তার জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া জানান, তিনি হেঁটেই যেতে পারবেন, হুইল চেয়ার ব্যবহার করবেন না। এরপর খালেদা জিয়া কেবিন ব্লকের সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করেন। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে তিনি উপস্থিত লোকজনের শুভেচ্ছার জবাব দেন হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে। মহিলা কারারক্ষীরা হাত ধরে তাকে সিঁড়ি পার করার পর তিনি ১৯ নম্বর লিফট পর্যন্ত হেঁটে যান। খালেদা জিয়াকে লিফটে তোলার পর সেখানে ব্যারিকেড দিয়ে সাংবাদিকসহ লোকজনের যাতায়াত বন্ধ করে দেয় পুলিশ। একই সময়ে তিনতলার সিঁড়িতেও লক করে দেয়া হয়। ১১টা ৩৮ মিনিটে তাকে পঞ্চম তলার ৫১২ নম্বর কেবিনে নেয়া হয়। এ সময় তার সঙ্গে সেখানে অবস্থান করেন বেশ কয়েকজন পুলিশ ও কারা কর্মকর্তা। প্রায় একঘণ্টা পর কেবিন ব্লক থেকে খালেদা জিয়াকে বের করে আনেন পুলিশ ও কারা কর্মকর্তারা। কারারক্ষী, র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবি পুলিশের সশস্ত্র পাহারার মধ্যদিয়ে ১২টা ৩৬ মিনিটে তাকে নেয়া হয় উল্টোপাশের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে। কেবিন ব্লক থেকে হেঁটেই সেখানে যান খালেদা জিয়া। এক্স-রে শেষে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে তাকে রেডিওলজি বিভাগের কাউন্টার গেটে আনা হয়। সেখানে তার সঙ্গে কয়েক মিনিট কুশল বিনিময়ের সুযোগ পান ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলী রহমান সিঁথি ও নাতনি। ঠিক ১টা ৩৩ মিনিটে রেডিওলজি বিভাগের উত্তরপাশের গেট দিয়ে বের করে তাকে তোলা হয় সেই কালো কাচঘেরা গাড়িতে।
এ সময় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান। পুলিশি বাধার মুখে তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে না পারলেও কাচ ধরে তাকে সালাম দেন। গাড়ি কারাগারের উদ্দেশে ফিরে যাওয়ার সময়ও গাড়িতে বসে হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে উপস্থিত লোকজনের শুভেচ্ছার জবাব দেন খালেদা জিয়া। এর আগে হাসপাতালের কেবিন ব্লকে একঘণ্টা অপেক্ষার পর রেডিওলজি বিভাগে তিনটি এক্স-রে করার পর ফিরিয়ে নেয়া হয় কারাগারে। পৌনে দু’টায় ফের চার দেয়ালের নিঃসঙ্গ, নির্জন কারাগারে বন্দি জীবন শুরু হয় খালেদা জিয়ার। মধ্যখানে হাসপাতালে গাড়ি থেকে নামিয়ে কেবিন ব্লক ও পরে রেডিওলজি বিভাগে নেয়ার সময় সেখানে উপস্থিত অল্পসংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ তাকে দেখার সুযোগ পান। পাশাপাশি ওই সময়ে ধারণকৃত ভিডিও এবং স্থিরচিত্রের মাধ্যমে সারা দেশের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ খালেদা জিয়াকে দেখতে পান। কেমন আছেন তিনি, কি তার শারীরিক পরিস্থিতি।
মতামত দিতে পারেনি ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ডাক পেলেও তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা মতামত দিতে পারেননি। বিএনপি’র আবেদনের প্রেক্ষিতে মহা কারাপরিদর্শকের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। সেখানে জেল কোড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা ছিল। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গতকাল ডাক পেয়েছিলেন তার চার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। যথাসময়ে তাদের মধ্যে তিনজন প্রফেসর ওয়াহিদুর রহমান, প্রফেসর এফএম সিদ্দিকী ও ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন বিএসএমএমইউতে এসেছিলেন। কিন্তু তারা কেউ খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসায় মতামত দিতে পারেননি। কারাগার থেকে হাসপাতালে এনেই খালেদা জিয়াকে নেয়া হয় আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা কেবিন ব্লকের ৫১২ নম্বর কেবিনে। কিন্তু সেখানে সর্বক্ষণ তাকে ঘিরে রেখেছিলেন পুলিশ ও কারা কর্মকর্তারা। তিন চিকিৎসককে তার কেবিনে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় প্রায় ২০ মিনিট পর। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেন সরকারি মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ীই তার পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে। এখানে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় তারা তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের মতামত নিতে পারবেন না। কেবল কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমেই শেষ হয় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের সাক্ষাতের পালা। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সেখানে প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে রাখার পর খালেদা জিয়াকে নেয়া হয় রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে। সরকারি মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী সেখানে তার তিনটি এক্স-রে করা হয়। ড্যাব’র কয়েকজন নেতা জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে একটা নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে মাত্র। যদি সরকারি মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী তার এক্স-রেই করা হবে তাহলে অযথা কেন কেবিন ব্লকে নেয়া, কেনই বা সেখানে একঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে রাখা হলো।  
স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট আজ: খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট আজ রোববার কারা কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুল্লাহ-আল-হারুন। তিনি জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার একাধিক এক্স-রে করা হয়েছে। দুপুরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে খালেদা জিয়া হাসপাতাল ত্যাগ করার পর বিএসএমএমইউ’র মিল্টন হলে পরিচালক এক প্রেসব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান। পরিচালক বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত ঢামেকের মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়েছে। তিনি সুস্থ কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে পরিচালক বলেন, এটি মেডিকেল বোর্ড বলতে পারবেন। তিনি সুস্থ নেই এটা বলা যাবে না। আপাতদৃষ্টিতে তাকে সুস্থ মনে হয়েছে। তার জন্য আমরা হুইল চেয়ার রেখেছিলাম। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, হেঁটেই যেতে পারবেন। পরিচালক বলেন, বিএসএমএমইউতে আসার পর তাকে কেবিন ব্লকের ৫১২ নম্বর কেবিনে নেয়া হয়। সেখানে বেগম জিয়া তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কেবিনে তার সঙ্গে তার চিকিৎসকরা কথা বলেছেন। সেখানে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. ওয়াহিদুর রহমান, ডা. এফএম সিদ্দিকী, ডা. মামুন ও কারা চিকিৎসক ডা. শুভ উপস্থিত ছিলেন। তারা এক্স-রে করার সময়ও উপস্থিত ছিলেন। পরিচালক বলেন, কেবিনে যাওয়ার পর তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এরপর রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের তার হাড়ের বিভিন্ন অংশের এক্স-রে করা হয় (মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী)। এখানে এক্স-রে ছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা করা হয়নি।
এদিকে বিএসএমএমইউ’র রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের ১/এ নম্বর রুমে এক্স-রে করান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সেখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নাজমুন নাহার প্রায় ২০ মিনিট ধরে খালেদা জিয়ার ঘাড়, কোমর এবং জয়েন্ট কোমরের (হিব) তিনটি পয়েন্টের এক্স-রে সম্পন্ন করেন। এক্স-রের সময় বেগম জিয়া খুব শান্ত ছিলেন বলে জানান তিনি। এ সময় রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. মো. এনায়েত করিম উপস্থিত ছিলেন।
রাতেই প্রস্তুতি, সকালে পুলিশ মোতায়েন
খালেদা জিয়ার মেডিকেল টেস্ট ও চিকিৎসার জন্য শুক্রবার রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্রস্তুতি শুরু হয়। এর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। গতকাল সকাল ৭টা থেকে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগার থেকে শাহবাগ বিএসএমএমইউ পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ওই সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেয়। বিএসএমএমইউ’র সামনে রাস্তায়, প্রধান ফটকে, হোটেল সোনারগাঁও মোড়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা ছিল পুলিশের। এছাড়া হাসপাতালের সামনে র‌্যাব, সাধারণ পোশাকে ডিবি, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, হাসপাতালের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীসহ বহু নিরাপত্তাকর্মী অবস্থান নেয়। হাসপাতালে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, রোগী ও তাদের স্বজনদের সকাল থেকেই তল্লাশি করে হাসপাতালে ঢোকানো হয়। হাসপাতাল গেটের কাছে নিশাত ফার্মেসিতে কথা হয় কর্মরত মো. জুনাইদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকালে ফার্মেসিতে আসার সময় দেখি হাসপাতালের উভয় দিকে পুলিশের অবস্থান। সেখানে কর্মরত একাধিক পুলিশ সদস্য সকাল ৭টা থেকে তারা ডিউটি করার কথা জানান। এদিকে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে আনার একদিন আগে গত শুক্রবার তার জন্য কেবিন ব্লকের পঞ্চম তলার ভিআইপি ডিলাক্স কেবিন (কক্ষ নম্বর-৫১২) নির্ধারণ করা হয়। ওই দিন কক্ষটিতে কয়েক দফায় ঝাড়-মোছ দেয়া হয় বলে জানান হাসপাতালের ক্লিনার ইনচার্জ আশরাফ আলম সোহেল।
গতকাল সকালেও কয়েক দফা তা পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। বৈদ্যুতিক লাইন, ফ্রিজ, টিভি, এসি ঠিকঠাক মতো কাজ করছে কিনা দেখে যান প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সকাল ৯টার পর বাথরুমের গরম পানির ঝর্ণা কাজ করছে কিনা দেখে যান প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারী আবদুস সামাদ। তিনি বলেন, মোটামুটিভাবে সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে। গরম পানির ঝর্ণাও যথাযথভাবে কাজ করছে। সকাল ৯টার পর ওই কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, কেবিন ব্লকের রাস্তার পাশের কক্ষটিতে দু’টি শয্যা, ৫টি চেয়ার, ২টি টেবিল, একটি করে আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল, টিভি ও ফ্রিজ রয়েছে। সামনের ছোট্ট কক্ষটিতে চারজন বসার দু’টি সোফা সেটের মাঝখানে একটি টেবিল। সবকিছু মুছে পরিষ্কার রাখা হয়। প্রথমেই তাকে সেই কেবিনে নেয়া হয়। ১১টা ৩৮ মিনিটে ৫১২ নম্বর কক্ষে ভিআইপি ডিলাক্স কেবিনে প্রবেশ করেন। এ সময় তার সঙ্গে ওই কক্ষে ঢুকেন বেশ কয়েকজন পুলিশ ও হাসপাতাল কর্মকর্তা। এরপর ওই কক্ষের সামনে কারারক্ষীরা অবস্থান নেন। এর আধাঘণ্টা পর বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে মেডিকেল টেস্ট করাতে যাওয়ার জন্য কেবিন থেকে বের হন। ৫১২ নম্বর কেবিনে একঘণ্টা ছিলেন তিনি।
দাদি-নাতনীর কুশলবিনিময়
খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার দেড় মাসের মাথায় বাংলাদেশে আসেন তার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলী রহমান সিঁথি ও তার দুই কন্যা জাহিয়া রহমান এবং জাফিয়া রহমান। দেশে ফেরার পর দুইদফায় কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। এদিকে গতকাল তাকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে শুনে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তারা হাসপাতালে আসেন। খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে আনার পর তারা কেবিনে ব্লকে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের অনুমতি পাননি। তারপর হাসপাতালের সি-ব্লকের সামনে গাড়িতে বসেছিলেন দীর্ঘক্ষণ। পরে তাদের নেয়া হয় হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়ের ওয়েটিং রুমে। এক্স-রে শেষে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়ার সময় রেডিওলজি বিভাগের কাউন্টার গেটের ভেতরে তারা কয়েক মিনিটের জন্য কুশল বিনিময়ের সুযোগ পান।  এদিকে এক্স-রে শেষে কারাগারের উদ্দেশে গাড়িতে তোলার সময় কেবিন ব্লকের বারান্দাগুলোতে রোগী, নার্স ও চিকিৎসকসহ উৎসুক মানুষ খালেদা জিয়াকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। জবাবে খালেদা জিয়াও হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন। উল্লেখ্য, ঠিক ১০ বছর আগে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জামিনে কারামুক্ত হওয়ার পর অসুস্থ বড় ছেলে তারেক রহমানকে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ডি ব্লকে এসেছিলেন খালেদা জিয়া। এবার তিনি নিজেই কারাবন্দি অবস্থায় অসুস্থ হয়ে এই হাসপাতালে এলেন।
রোগীদের ভোগান্তি
খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউ আনা উপলক্ষে গতকাল হাসপাতালটিতে সাধারণ রোগীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে তারা ভোগান্তিতে পড়েন। শুক্রবার হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় শনিবার রোগীর চাপ বেশি থাকে এই হাসপাতালে। কিন্তু সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর আসা উপলক্ষে হাসপাতালে বিভিন্ন সেবা কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের। তারা জানান, হাসপাতালের প্রবেশ পথেই পুলিশের জেরার মুখোমুখী হতে হয়েছে তাদের। স্বজনদের অভিযোগ সকাল থেকে কেবিন ব্লকের নিচে এবং এর সামনে বি-ব্লকের নিচে এক্স-রে এবং আলট্রাসনোগ্রামের কাউন্টার বন্ধ করে দেয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে দুপুর ২টার দিকে কাউন্টারগুলো খোলা হবে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীদের। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বহু রোগী।
ড্যাব নেতাদের পুলিশের বাধা, মিছিল ও গ্রেপ্তার
ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-নেতারা বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা নিতে আসা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কেবিন ব্লকের নিচে ৯টার পর থেকে জড়ো হতে থাকেন। এক পর্যায়ে ২০/২৫ চিকিৎসক একত্রে হলে পুলিশ তাদের কেবিন ব্লকের নিচে দাঁড়ানো যাবে না বলে সড়িয়ে দেন এবং কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হন। এতে সংগঠনটির নেতা প্রফেসর ডা. সিরাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে অবস্থান নেয়া চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদিকে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়ার খবরে কারাগেট ও বিএসএমএমইউ হাসপাতাল এলাকায় জড়ো হয় বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়িবহর হাসপাতাল ঢোকার পর গেটের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা। পুলিশ সেখান থেকে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে কেবিন ব্লকে নেয়ার পর কেবিন ব্লকের সামনে থেকে ছাত্রদলের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখারুজ্জমান শিমুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিএনপি কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, বিএনপি ও অঙ্গদলের ১১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে রমনা ও শাহবাগ থানা পুলিশ। তবে পুলিশের তল্লাশির মধ্যেও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, প্রফেসর আজিজুল হক, প্রফেসর সিরাজউদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর আবদুল কুদ্দুস, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, আফরোজা আব্বাস, আবদুস সালাম আজাদ, শহীদুল ইসলাম বাবুল, নজরুল ইসলাম আজাদ, তাবিথ আউয়াল, আমিরুজ্জামান শিমুল ও জি৯ এর সমন্বয়ক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ সহ অনেকেই হাসপাতাল চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলেন। এদিকে খালেদা জিয়াকে কারাগারের উদ্দেশে হাসপাতাল থেকে বের করার পরপরই শাহবাগ আজিজ মার্কেটের সামনে মিছিল বের করে ছাত্রদল। ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুনুর রশীদ মামুন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান, সহ-সভাপতি আলমগীর হাসান সোহান, নাজমুল হাসান, আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, যুগ্ম সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক, কাজী মোকতার হোসেনসহ কেন্দ্রীয়, ঢাকা মহানগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কয়েকশ’ নেতাকর্মী মিছিলে অংশ নেন। মিছিলটি কাঁটাবন মোড় হয়ে হাতিরপুলের দিকে গেলে ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।
জোর করে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে: রিজভী
বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে জোর করে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিকালে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। রিজভী বলেন, সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুতভাবে আনা হয়েছে। কারাগারে তাঁর কক্ষের কাছে গিয়ে বারবার তাগিদ দিতে থাকে কারাকর্মকর্তাসহ ৭-৮ জন কারারক্ষী। একজন মুসলিম ধর্মপ্রাণ নারী হিসেবে ৩০-৩২ বছর ধরে তিনি শাড়ির উপরে চাদর বা ওড়না পরিধান করেন। এ সরকার এতো হীন এবং কুৎসিত মনোবৃত্তির যে, একজন বয়স্ক নারী যিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাঁকে চাদর বা ওড়না পরিধান করার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। একরকম জোর করেই তাকে গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে পিজি (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ৫১২ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু চিকিৎসার নামে পিজি হাসপাতালে নিয়ে আসা প্রহসনেরই নামান্তর। কারণ সেখানে কোনো চিকিৎসাই তাঁকে দেয়া হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের কোনো পরামর্শের সুযোগ দেয়া হয়নি। আইনেও আছে একজন বন্দি পূর্বে যেসব চিকিৎসকের চিকিৎসা নিতেন কারাগারেও তাদের চিকিৎসা নিতে পারবেন। গত পরশু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দ্বারা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে প্রধান কারারক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। অথচ এর কোনো প্রতিফলন আজকে দেখা যায়নি। রিজভী বলেন, খালেদা জিয়া ১৫-২০ বছর ধরে যে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের চিকিৎসা প্রদানের কোনো সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। একজন মানুষ হিসেবে বেগম জিয়ার যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সেটাকেও হরণ করতে ক্ষমতা তপস্বী সরকারপ্রধান বিষ দাঁত লুকাতে পারছেন না। অথচ নিজেকে সাধু দেখানোর জন্য বেগম জিয়ার চিকিৎসার নামে নাটক করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে আনা হয়েছে। এতকিছুর পরও সরকারের উদ্দেশ্য যে অশুভ নয় এটা আমরা কিভাবে বুঝবো। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে গেলে সেখানে তাদের পর্যন্ত দেখা করতে দেয়া হয়নি। বেগম জিয়াকে বহনকারী গাড়ি হাসপাতালে পৌঁছলে একরকম টানা হেঁচড়া করে ওপরে উঠানো হয়। গাড়ি থেকে নামার জন্য সিঁড়ি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে হাসপাতালে ধাক্কাধাক্কির মতো পরিস্থিতিতে অপমানজনকভাবে তাঁকে হাসপাতালে ওঠানো-নামানো হয়েছে। রিজভী বলেন, আওয়ামী রাজত্বে সরকারি হাসপাতালে বিরোধী দলের সেবা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেই সুযোগ ও অধিকারহীনতার শিকার হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে সরকার আজ যে বায়েস্কোপ দেখালো তার নিন্দা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সরকারের উদ্ভট আচরণের তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাচ্ছি। এ সময় তিনি বলেন, সুচিকিৎসার অভাবে খালেদা জিয়ার কোনো ক্ষতি হলে এর দায় সরকারকে নিতে হবে। বেগম জিয়ার অগ্রযাত্রায় বলপূর্বক প্রতিহত করে কোনো লাভ হবে না। কোনোভাবেই তাঁকে টলানো যাবে না। এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, আবদুস সালাম, প্রফেসর ডা. সিরাজউদ্দিন আহমেদ ও প্রফেসর ডা. আবদুল কুদ্দুস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.