চট্টগ্রামে চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস তৎপরতা নেই পাউবোর

দরজায় কড়া নাড়ছে গ্রীষ্ম। আর সেই সঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে তাপদাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও আকস্মিক বন্যা। যার হাত১ থেকে রক্ষার কোনো উপায় নেই চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার উপকূলবাসীর। অথচ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ ব্যাপারে তাদের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। উপকূলবাসীর ভাষ্য, চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকার রক্ষাবাঁধগুলোর সব ক’টিই ঝুঁকিপূর্ণ। সামান্য বৃষ্টি ও সাগরের স্বাভাবিক জোয়ারেও বেড়িবাঁধ ডিঙিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় এলাকা। এ অবস্থায় চলতি এপ্রিল মাসেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে চরম উৎকণ্ঠায় পড়েছেন উপকূলবাসীরা। উপকূলবাসীর অভিযোগ, উপকূল রক্ষাবাঁধগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। এ নিয়ে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখা গেল সত্যিই; উপকূল নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই পাউবোর চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের। পাউবো চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা এ প্রসঙ্গে বলেন, জেলার উপকূলীয় তীরবর্তী এলাকা আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া, সীতাকুণ্ড, সাতকানিয়া, চন্দনাইশসহ আরো কয়েকটি এলাকায় বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে। একই সঙ্গে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম শহররক্ষা বাঁধ। বরাদ্দ না পাওয়ায় এসব বাঁধের কাজ এগোচ্ছে না। তিনি বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য প্রকল্পগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এতে আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের কাজ আমরা করেছি। তাই আমরা চিন্তামুক্ত। তবে ছোটখাটো বরাদ্দ যা পাচ্ছি তাতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছি। পাউবো সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ২০১০ সালে উপকূলীয় ফোল্ডার নং ৬২ (পতেঙ্গা), ৬৩/১ (আনোয়ারা), ও ৬৩/১(বি) সংক্রান্ত আনোয়ারা ও পটিয়ার বাঁধ মেরামত ও ৬৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণের কাজের জন্য একটা পুনর্বাসন প্রকল্প তৈরি করে পানিসমপদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২৯১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত এ প্রকল্প যাচাই-বাছাই শেষে ২৭৫ কোটি টাকায় নির্ধারিত হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের কোনো খবর নেই। সূত্র জানায়, ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর ’৯৩ সাল থেকে ’৯৬ সালের মধ্যে বেড়িবাঁধটি সিইআরপি নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যাপক আকারে সংস্কার করা হয়। পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি থেকে পরবর্তী এক কিলোমিটার পর্যন্ত সী-ওয়াল নির্মাণ করে মেরামত করা হয়। এরপর পতেঙ্গার হোসনে আহমদপাড়া থেকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ব্যয় হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া বাকি ১০ কোটি টাকা পতেঙ্গা থেকে খেজুরতলা পর্যন্ত চার দশমিক ২৪ কিলোমিটার সাগর পাড়ে পাথরের ব্লক বসানো, ১৬টি স্লুইচগেট নির্মাণ এবং সামগ্রিক খাতে খরচ করা হয়েছে। এরমধ্যে গত বছর পাউবোর জরিপে বেড়িবাঁধের হোসেন আহমদপাড়া, আনন্দবাজার এবং খেজুরতলাকে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া মুসলিমাবাদ থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আরও বিভিন্ন অংশে ফাটল থাকলেও এ ফাটল কিংবা ভাঙন তেমন বিপজ্জনক নয় বলে মনে করছে পাউবো। এছাড়া জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে পশ্চিম পটিয়া (কর্ণফুলী থানা)র চরপাথরঘাটা, চরলক্ষ্যা, শিকলবাহা, জুলধা ও বড়উঠান, আনোয়ারা উপজেলার গহিরা, রায়পুর, বারশত ইউনিয়ন, জুঁইদন্ডি, বরুমছড়া, বারখাইন, হাইলধর, বাঁশখালী উপজেলার  ছনুয়া, গন্ডামারা, সরল, খানখানাবাদ, বাহারছড়া, কাথারিয়া, পুঁইছড়ি, শেখেরখীল, শীলকুপ, চাম্বল, পুকুরিয়া, সাধনপুর ও কালীপুর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে এসব এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এতে বাড়িঘর হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যান। চট্টগ্রাম নগরীর নিকটতম এ এলাকায় দীর্ঘ ২২ বছরেও ঘূর্ণিঝড়ে মোকাবিলায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। নির্মাণ করা হয়নি বেড়িবাঁধ। কিছু কিছু এলাকায় দুই-একটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হলেও তা জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। আবার অধিকাংশই ব্যবহারের অনুপযোগী। উপকূলবাসীর অনেকে জানান, প্রতি বছরই ২৯শে এপ্রিল তাদের নতুন করে ভাবায়। এদিন ম্যারিএন নামক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তুূপে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো হয়নি। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে আনুমানিক ১ লাখ ৩৮ হাজার জন মানুষ নিহত এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। ২৯শে এপ্রিলের মতো বড় কোনো ঘটনা যদি আবার ঘটে, এমন চিন্তা মনে আসতেই আঁৎকে উঠে উপকূলবাসী।
তাই চট্টগ্রাম নগরীসহ জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে শিগগিরই বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুন:নির্মাণের দাবি তাদের। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ ফরিদ উদ্দিন জানান, চলতি মাসে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এবং ভারী বর্ষণে চট্টগ্রামসহ পাহাড়ি এলাকায় আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে উপকূলবাসী। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসে মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে চট্টগ্রাম বন্দর ও বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিভিন্ন বেসরকারি আইসিডি, চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোমপানির ডিপো, নৌ ও বিমানবাহিনীর স্থাপনা, সাইলো জেটি, খাদ্য গুদাম, ইস্টার্ন ক্যাবলস এর কারখানার মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এছাড়া নগরীতে উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী, ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা, ৩৭ নম্বর উত্তর-মধ্যম হালিশহর, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা (একাংশ) এবং ৪১ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা (বাকি অংশ)। পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত মোট ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২২ কিলোমিটারই বর্তমানে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়া এবং কিছু অংশ একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বড় ধরনের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে নগরীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বলে জানান স্থানীয়রা।

No comments

Powered by Blogger.