মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য by ফোরকান আহমেদ

অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চলে আসছিল, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এখনো সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলায় তথা ’৪৭-এর আগে এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে হাজী মুহম্মদ মুহসীনের নাম এবং আধুনিক যুগে সর্বাগ্রে অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম স্মরণযোগ্য। শিক্ষা বিস্তারে, বিশেষত অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কল্যাণে হাজী মুহম্মদ মুহসীনের অবদান এখনো বাংলাদেশের মানুষদের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলে আছে; কিন্তু নবীন প্রজন্মের কাছে এ মহৎ মানুষটিকে সেভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি আমাদের বিজ্ঞজনেরা। এখন আর মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে মুহম্মদ মুহসীনের নাম সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। হাজী শরীয়তুল্লাহ, শেরেবাংলা ও মওলানা ভাসানীর ইতিহাস অদূর ভবিষ্যতে যদি আড়াল হয়ে যায়, তাহলে একদিন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাসও আড়াল হয়ে যেতে পারে। জাতির এ সন্ধিক্ষণে উল্লিখিত মহান ব্যক্তিত্বদের জীবনী আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়কে ইতিহাসবিদদের যথাযথ গুরুত্ব দেয়া দরকার। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী ২৮ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার শেরপুরে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ইসলামের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত বলেই দেশে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছেন।
অতীতে কেউ তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। কাজেই মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার চাইলে আরেকবার ক্ষমতায় আনতে হবে বর্তমান সরকারকে। মন্ত্রী তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আরো বলেছেন, বিভিন্ন মাদরাসার পরীক্ষা চলাকালে তিনি দেখেছেন মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা নকল বা অসদুপায় অবলম্বন করা পছন্দ করে না। আমরা বলব, মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করে নৈতিক শিক্ষার শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোকে জাতীয়করণ করুন। এর প্রতিশ্রুতি আপনারাই দিয়েছেন। একই সাথে, ইতিহাস পর্যালোচনা করে মাদরাসা শিক্ষার হারানো ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন। তাহলেই দেখবেন প্রশ্নফাঁস, বিভিন্ন সেক্টরের ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়ম হ্রাস পেতে শুরু করবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৎ হিসেবে গড়ে ওঠা এবং তাদের শিক্ষিত ও মেধাবী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশ বহুদূর এগিয়ে যাবে। নয়া দিগন্ত ২৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ‘মোহসীনিয়া মাদরাসা যেভাবে হলো কবি নজরুল কলেজ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- দানবীর হিসেবে খ্যাত হাজী মুহম্মদ মুহসীনের রেখে যাওয়া অর্থে ১৮৭৪ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় মোহসীনিয়া মাদরাসা। অল্প সময়েই এ মাদরাসার খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৮০ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত আলিয়া মাদরাসার সাথে তুলনা করা হতো ঢাকার মোহসীনিয়া মাদরাসাকে। সে কারণে মাদরাসাটি পরিচিত পায় ‘ঢাকা মাদরাসা’ নামে এবং এ নামেই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে; কিন্তু বিভিন্ন কারণে মাদরাসাটি দুর্ভোগের শিকার হয়। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত মাদরাসাটি হাজী মুহম্মদ মুহসীনের অর্থে পরিচালিত হয়েছে। ওই সংবাদে আরো উল্লেখ করা হয়, ১৯১৪-১৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার নিউ স্কিম মাদরাসা চালু করার কারণে এ মাদরাসাসহ আরো অনেক মাদরাসা শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের কারণে এসব মাদরাসা তাদের ধর্মীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। ফলে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাধারণ শিক্ষায় আগ্রহী সাধারণ মানুষ। এভাবে মাত্র ৪৯ বছরের মাথায় মোহসীনিয়া মাদরাসাটি হয়ে গেল একটি কলেজ। ১৯৬৮ সালে এর নতুন নামকরণ করা হয় সরকারি ইসলামিয়া কলেজ। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘কবি নজরুল সরকারি কলেজ’।
অপর দিকে চট্টগ্রামের মুহসীন কলেজও ছিল একটি মাদরাসা। হাজী মুহম্মদ মুহসীন ফান্ডের অর্থে ১৮৭৪ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম মাদরাসা’। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো রাজশাহীতেও ১৮৭৪ সালে মুহসীনের রেখে যাওয়া অর্থেই প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি মাদরাসা। প্রথমে এর নাম ছিল দরসে নিজামিয়া সিনিয়র মাদরাসা। ১৯৬০ সালে এর নামকরণ হয় রাজশাহী সরকারি মাদরাসা। ১৯৬০ সালে মাদরাসাটিকে রূপান্তর করা হয় একটি হাইস্কুলে। তবে হাইস্কুলে পরিণত করা হলেও আজো এর নাম রাজশাহী সরকারি মাদরাসাই রয়ে গেছে। তবে ২০১২ সালে ৭ অক্টোবর রাজশাহী জেলা প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মিলে এর নতুন নামকরণ করেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। পরবর্তীকালে একে সিটি ইউনিভার্সিটি করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ওই সভায়। নৈতিক শিক্ষাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষের বক্তব্য- আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি রয়েছে জাতির অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। আমাদের জাতীয় কবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তিনি এই কবিকে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ ও শান্তিপ্রিয় মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবি জাতীয় কবির নামে কবি নজরুল কলেজের আদলে ঢাকায় অন্য স্থানে কবি নজরুলের নামে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং বর্তমান কবি নজরুল কলেজের স্থলে এবং এর সাবেক নাম মোহসীনিয়া সিনিয়র মাদরাসা হিসেবে বর্তমান ভবনটিকে মাদরাসায় রূপান্তর করা হোক। একইভাবে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মাদরাসাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষায় যুগান্তরকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। মাদরাসা শিক্ষার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনুন, এ জন্য বিলুপ্ত মাদরাসাগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.