গ্রাম ভালোবাসতেন তিনি by দেওয়ান সামছুর রহমান

কবি জসীম উদ্দীনের বাবার এক চাচার নাম ছিল দানু মোল্লা। তিনি ছিলেন অন্ধ। তাই লেখাপড়া শিখতে পারেননি। কবির সেই দাদা ছিলেন অসাধারণ কেচ্ছা-কাহিনীর এক জীবন্ত ভাণ্ডার। তার গলার সুরও ছিল চমৎকার। সুন্দরভাবে পশু-পাখির ডাক নকল করতে পারতেন। কবি সেই দাদার সংস্পর্শে রূপবান, মধুমালার কাহিনী জেনেছেন। সুরের প্রতি, গানের প্রতি, পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা শিখেছেন সেই শিশুকালে অন্ধ দাদার কাছ থেকে। ঢাকায় কবির কমলাপুরের বাড়িটি ছিল গাছপালায় ভর্তি। গাছের ডালে কবি কলসি ঝুলিয়ে রাখতেন পাখিদের থাকার জন্য। তিনি প্রতিদিন খই-মুড়ি গাছের তলায় ছড়িয়ে দিতেন পাখির খাবার হিসেবে। বাগানের সামনে উঠানের মতো জায়গায় সবুজ ঘাসে কবি তার ভক্তদের নিয়ে গানের আসর জমাতেন। ঢাকা শহরে নিজ গৃহকে কবি পল্লীর পরিবেশে সাজানোর চেষ্টা করতেন। তার পল্লী নিবাসে প্রবেশ করলেই মনে হতো শহর ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছি। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নিজের মামার বাড়িতে জন্মেছিলেন কবি জসীম উদ্দীন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুরের গোবিন্দপুর, যার বর্তমান নাম অম্বিকাপুর। বাবা মৌলভী আনসার উদ্দীন মোল্লা এবং মা আমেনা খাতুন। দাদা ছমিরউদ্দীন মোল্লা। তাদের বংশীয় উপাধি মোল্লা হলেও তিনি তার নামের সঙ্গে শব্দটি ব্যবহার করতেন না। তার ছদ্মনাম ছিল তুজম্বর আলী। পাঁচ বছর বয়সে শোভারামপুরের অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায় কবির প্রথম পাঠ শুরু। কিছুদিন পর পাঠশালা ছেড়ে তার পিতার তত্ত্বাবধানে ফরিদপুরের হিতৈষী স্কুলে ভর্তি হন। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতেন। বাবাকে ডাকতেন বাজান বলে। এই বিদ্যালয়ে তিনি প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন।
চারদিকে যখন ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, কবি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল-কলেজের ছেলেরা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে স্কুল ছেড়ে অনেক কষ্টে কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হন। কলকাতার গলিতে গলিতে ঘুরে খবরের কাগজ বিক্রি করেন আর কবিতা লেখেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে তার কবিতার খাতা দেখান। ১৯২১ সালে মোসলেম ভারত পত্রিকার যে সংখ্যায় নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হল, সে সংখ্যায়ই কবির ‘মিলন গান’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম রচনা এটি। জসীম উদ্দীন ১৯২১ সালে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আইএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৪ সালে আইএ পাস করেন এবং আইএ ক্লাসে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই ড. দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পল্লীগীতি সংগ্রাহক নিযুক্ত হন। ১৯২৫ সালে প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা ‘কল্লোল’-এ ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে দেশের সুধী সমাজে তার পরিচিতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ছাত্রাবস্থায় লেখা তার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘পল্লীজননী’ ও ‘কবর’সহ মোট আঠারটি কবিতা ও পাঁচটি গ্রাম্য গান নিয়ে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। কবি তার জীবদ্দশায় অনেক সম্মান ও প্রতিপত্তি পেয়েছেন। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কবি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাদীর কবরের পাশে ডালিম গাছের তলে সমাহিত করা হয়।
দেওয়ান সামছুর রহমান : প্রাবন্ধিক
dewanghs@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.