মাতৃভাষা নিয়ে লড়াই by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই ভাষা-সংখ্যালঘুদেরই করতে হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আমরা, অর্থাৎ বাঙালিরা সংখ্যাগুরু ছিলাম পরিসংখ্যানের বিচারে, ক্ষমতার বিচারে সংখ্যালঘু। সে জন্য ভাষা নিয়ে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল। বাংলাদেশে বাঙালিরা সব অর্থেই গরিষ্ঠ, এখন মাতৃভাষা নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে। এর মধ্যে তাদের কিছু ভাষা হারিয়ে গেছে। বাকিগুলো থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় সমর্থন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং মাতৃভাষার প্রতি এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর অঙ্গীকারের ওপর। আমরা আশা করব, এই ভাষার মাসে বিপন্ন মাতৃভাষাগুলোর প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার কথাটা আমরা মনে রাখব। মাতৃভাষা নিয়ে এখন বাঙালিদের লড়াইয়ের চরিত্রটা পাল্টে গেছে। একটা সময় ছিল-স্বাধীনতার কিছুকাল পর পর্যন্তও-যখন বাঙালি মাত্রই ধরেই নিত, স্বাধীন বাংলাদেশে মাতৃভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম; এই ভাষায় সরকারি, বেসরকারি, বিচারিক সব কাজ করা হবে। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যও বাংলাকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করবে। স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর চলে গেল-এখনো শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার সর্বজনীন নয়, উচ্চ আদালতের কাজকর্ম চলে ইংরেজিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা, তথাকথিত করপোরেট ভাষা শুরু থেকেই ইংরেজি। সরকারি দপ্তরে বাংলার ব্যবহার আছে এবং সেটি প্রশংসনীয়, কিন্তু যথাযথ পরিভাষার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজির আবশ্যকতা থেকেই গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় কেন শিক্ষা দেওয়া হয় না, সেই প্রশ্ন তুললে বলা হয়, তাহলে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা কোনো দিনই পেরে উঠব না। ভালো কথা, ইংরেজিতে পড়াশোনা করে আমরা বিশ্বকে হারাব, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব রাস্তায় হেঁটে আমরা মণিমাণিক্য কুড়াব। কিন্তু তা তো আর হয়নি। প্রকৃত অবস্থাটা হলো, আমরা ইংরেজিতে অতিশয় দুর্বল। যদি বুঝতাম ইংরেজিটা তেমন না শিখতে পারলেও বাংলা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, তাহলেও হতো। কিন্তু এখানেও বাস্তবতা ভিন্ন। মাতৃভাষায় নির্ভুলভাবে লেখা ও বলার ক্ষেত্রে আমাদের সামর্থ্য হতাশাজনক। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের লড়াইটা এখন আর এর অধিকার প্রতিষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লড়াইটা এর যথাযথ শিখন, ব্যবহার ও চর্চা এবং এর বিকাশ নিয়েও। বাংলা এখন ভয়ানক মিশ্র একটি ভাষা। সব ভাষাই কমবেশি মিশ্র ভাষা, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষার অনেক রূপের মধ্যে একটি থাকে যা ব্যবহৃত হয় এর সৃজন ও মননশীল কল্পনা প্রকাশে। এই ভাষাটি সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন সাধনা ও উন্নত চিন্তার প্রকাশের মাধ্যম। এর বাইরে আঞ্চলিক ভাষা থাকে, কথ্য ভাষা থাকে, খিস্তিখেউড়ের এবং চৌরাস্তার ভাষা থাকে। গণমাধ্যমও ভাষা তৈরি করে। তাতে তো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি একটার সঙ্গে আরেকটা লেপ্টে যায়, জট বেঁধে যায় জ্ঞান প্রকাশের ভাষার সঙ্গে চৌরাস্তার ভাষার, তাহলে তো বিপদ। বিপদ আসে ভাষার ছয় আনা ইংরেজি শব্দের দখলে চলে গেলে। অনেকে অবশ্য এসবকে বিপদ মানতে রাজি নন। বলেন, এটিই স্বাভাবিক। যদি স্বাভাবিকই হয়ে থাকে, তাহলে এই দায়টা শুধু বাংলার কেন? এই ‘স্বাভাবিক’-এর প্রকাশ ইংরেজি বা স্প্যানিশ ভাষায় দেখি না কেন? চৈনিক ভাষায় এই স্বাভাবিকতা নেই কেন? ইংরেজি ভাষাটা আমাদের শিখতে হবে, যেহেতু বৈশ্বিক বাস্তবতা এটি শেখার পক্ষে।
কিন্তু বাংলার জায়গাটা যেন ইংরেজির হাতে আমরা ছেড়ে না দিই; এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ যা, বাংলার বিশেষণ ও ক্রিয়াপদকেও যেন ইংরেজির হাতে তুলে না দিই। একই কথা খাটে আরবি, স্প্যানিশ বা ফরাসি ভাষারÿ ক্ষেত্রে। আমি একটি ভাষায় অন্য একটি ভাষার অনেক শব্দ অনিবার্যভাবে ঢুকে পড়াকে স্বাভাবিক বলি এবং এগুলো জোর করে বের করার প্রচেষ্টাকে অস্বাভাবিক বলি। একসময় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিতজনেরা বাংলা থেকে আরবি-ফারসি শব্দ বের করে দিয়েছিলেন। এতে বাংলা দুর্বল হয়েছিল। বাংলায় প্রতিবছরই নতুন বিদেশি শব্দ ঢুকবে কিন্তু সেগুলো হবে মূলত বিশেষ্য শব্দ এবং এতে বাংলা ভাষার মূল কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, অথবা প্রচলিত বাংলা শব্দকে এগুলো বিদায় করে দেবে না। আমি যাকে স্বাভাবিক বলতে রাজি নই, তা ভাষা নিয়ে অরাজকতা। একটি নির্ভুল বাক্য বলতে বা লিখতে না পারা, অকারণে ইংরেজি শব্দের দ্বারস্থ হওয়া, ইচ্ছা করেই ভাষাকে বিকৃত করা-এসব আমাকে হতাশ করে। আমি বিশ্বাস করি, কোনো ভাষা ব্যবহারকারীর ভাষায় যদি একটা নান্দনিক শৃঙ্খলা না থাকে, তার চিন্তাতেও শৃঙ্খলা আসবে না। একজন টিভি প্রতিবেদক যখন একটি সামান্য বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে ‘কিন্তু’ এবং ‘আসলে’র আক্রমণে তার বাংলাকে দুর্বল করে ফেলেন, দেখা যায় দুই মিনিটেও তিনি মূল কথাটিই বলতে পারছেন না। এ রকম কেন হবে? ভাষার মাসে আমি ভাষার সব রূপের বিকাশ চাই। স্বাস্থ্যবান মাতৃভাষা চাই, যা পরনির্ভর এবং অসুখপ্রবণ নয়, যার ভেতরের গানটা সুর-তাল হারাবে না। ভাষার মাস শুরু হয় বইমেলার দ্বারোদ্ঘাটন দিয়ে। আমাদের দেশে একসময় বই পড়ার একটা সংস্কৃতি ছিল। দৃশ্যমাধ্যমের প্রাবল্যে তা দুর্বল হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, তা যেন ফিরে আসছে। বইমেলা বই পড়ার চর্চা বাড়ায়। এখন সারা দেশে সারা বছর বইমেলা হয়। অনেকে বলেন, প্রতিবছর ছাপানো বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে বটে, কিন্তু মান কি বাড়ছে? আমি বলি বই যে ছাপা হচ্ছে, এ বিষয়টাকেই আমরা প্রথম উদ্যাপন করব। একটি বইয়ের মান আছে কি নেই, তা ঠিক করবেন পাঠক। পাঠকের হাতে এই দায় ছেড়ে দেওয়া যায়। ভাষা ব্যবহারের প্রথম তালিমটি একটি সন্তান পায় তার মা, বাবা অথবা পরিবারের অন্য কারও থেকে। তারপর স্কুলে। এই দুই জায়গাতেই এখন একটি অভাব দেখা দিয়েছে। পরিবারের ক্ষেত্রে অভাবটা সময়ের অথবা ইচ্ছার অথবা সামর্থ্যের, স্কুলেরÿ ক্ষেত্রে সুযোগের। এখন যে পরীক্ষাপ্রবণ, মুখস্থপ্রধান শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে, তাতে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে সৃজনশীল ভাষা ব্যবহারের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। এখন মুখস্থ চর্চাই নিয়ম। শিক্ষকেরা এই নিয়মের বাইরে যেতে চান না। যে শিক্ষাব্যবস্থা কল্পনাশক্তিকে জাগায় না, মনের দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয় না, শিক্ষার্থীর ভেতর তার চারপাশ ও বিশ্বকে নিয়ে কৌতূহল জাগায় না, সেই শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাচর্চাও হবে ধরাবাঁধা। সেটি সবল এবং সৃজনশীল হবে, তেমন ভাবার কারণ নেই। ভাষার মাসে শিক্ষা নিয়েও লড়াই করার একটা অঙ্গীকার আমাদের করতে হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.