ইরান-ইসরাইল মুখোমুখি by আনিসুর রহমান এরশাদ

ইরান-ইসরাইল শত্রুতা-তিক্ততা নতুন কিছু নয়। ইসরাইলের অভিযোগ- সিরিয়া ও লেবানন সীমান্তের কাছে কালামন পাহাড়ে ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলারা স্থায়ীভাবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। সিরিয়া ও লেবাননে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কারখানা স্থাপন করছে ইরান। সিরিয়া যুদ্ধে ইরানসমর্থিত আসাদ সরকারের টিকে যাওয়া ও রাশিয়ার উপস্থিতি ইসরাইলের জন্য স্থায়ী উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ইসলামিক স্টেট বা আইএসের পরাজয়ের পর দামেস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ইসরাইল সীমান্ত পর্যন্ত ইরানের প্রভাব বিস্তারে উদ্বিগ্ন ইসরাইল ইতোমধ্যে সিরিয়ার অভ্যন্তরে বেশ কয়েকবার বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরাকেও তেহরানের প্রভাব বৃদ্ধি ও লেবাননে হিজবুল্লাহ দুর্দমনীয় হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হওয়ায় ইরানি প্রভাব ঠেকাতে রিয়াদ-তেলআবিবের ঝুঁকিপূর্ণ জোট গঠনের পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্য কৌশলগত সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছে। সিরিয়ায় ইরানের আধিপত্য রুখে দেয়ার হুমকি দিয়েছে ইসরাইল। এরপরই ইসরাইলকে উড়িয়ে দেয়ার পাল্টা হুমকি দিয়েছে তেহরান। ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বশক্তি দিয়ে তেলআবিবের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নিজে। ইরান যাতে ইসরাইলের নির্ধারিত ‘রেড লাইন’ অতিক্রম না করে, তা তিনি নিশ্চিত করতে বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে। তিনি পুতিনকে বোঝাতে চেয়েছেন, ইরাক-ইয়েমেন-লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে ইরান।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না, সুন্নি ইসলামিক সন্ত্রাসের জায়গায় ইরানের নেতৃত্বে কোনো শিয়া ইসলামিক সন্ত্রাস আসুক।’ এমতাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সঙ্ঘাত সৃষ্টির যেকোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তেহরানকে সিরিয়ায় গঠনমূলক ভূমিকা পালনকারী বলেই মনে করে রাশিয়া। দেশের ভেতরে বা বাইরের চাপ সামলাতে তুরস্ক ও রাশিয়া বলয়ে থেকে সবল অবস্থান ধরে রাখার দিকেই নজর দিচ্ছে ইরান। মধ্যপ্রচ্যের অন্য দেশগুলোর তুলনায় ইরানের সামরিক সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী। স্থল, নৌ ও বিমান শক্তির দিক থেকে ইরান স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সাবেক প্রধান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরাক এখন ইরানের মিত্রে পরিণত হয়েছে। ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়ায় এখন সরাসরি কিংবা প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে তেহরান। আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকাতেও ইরান নিজের উপস্থিতি জোরদার করেছে। অন্য দিকে ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে টিকে থাকার জন্য ইরানের ধ্বংস চায়। কারণ ইরানই তাদের জন্য চোখ রাঙানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাসকে অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে ইসরাইল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ইরান তার লেবাননি মিত্র হিজবুল্লাহর মাধ্যমে লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। আগামী দিনে শিয়া-মিলিশিয়াদের মাধ্যমে ইরান সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণও নিতে চাচ্ছে। ইরাকের করিডোর ব্যবহার করে সিরিয়া-লেবানন যদি ইরানের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। তার অভিযোগ সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা ব্যবহার করে ইরান যদি ইসরাইলকে আক্রমণ করে অথবা ইরানিরা গোলানের কাছাকাছি আসে তাহলে আমরা তা মোটেও সহ্য করব না।’ ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কয়েকটি অস্ত্র কারখানায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইরানের চারজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে ইসরাইলি গুপ্তঘাতকেরা হত্যা করেছে। তেহরান বধে রিয়াদকে সহযোগিতা করতে চায় তেলআবিব, ইরাককেও সব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক কমিটির প্রধান অ্যাভি দিখতার বলেছেন, ‘সিরিয়া, জর্দান ও মিসর ছিল ইসরাইলের শত্রু দেশ। এখন মিসর ও জর্দানের সাথে শান্তিচুক্তি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখন ইসরাইলের রয়েছে চারটি শত্রু তথা সিরিয়া, লেবানন, গাজা উপত্যকা ও ইরান। ইসরাইল কয়েকটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর বৈরী প্রতিবেশীগুলোর মোকাবেলায় শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। কিন্তু ইরান এখন ইসরাইলের চোখে নিরাপত্তার জন্য নিকটতম বিপদে পরিণত হয়েছে। ইসরাইল বলেছে-  যদি রাশিয়া ইসরাইলের শত্রুদের সাহায্য না করে, ইসরাইলও রাশিয়ার শত্রুদের সাহায্য করবে না। ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং এই ক্ষেপণাস্ত্র দেশটির অন্যতম প্রতিরক্ষা বুহ্য। ইরান প্রতিরক্ষা শিল্পে আত্মনির্ভরশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। সামরিক বিবেচনায় ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের একক বৃহৎ শক্তি। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে অত্যন্ত দ্রুতগতির যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে। এসব যুদ্ধজাহাজ ঘণ্টায় ৮০ নটিক্যাল মাইল বা প্রায় দেড়শ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে বলে জানিয়েছে দেশটির নৌবাহিনী। ইরান বর্তমানে তাদের আকাশ পথে অত্যাধুনিক কিছু যুদ্ধবিমানের সংযোগ ঘটিয়েছে। ১৯৭৯ সাল থেকে ইরানের দু’টি সামরিক বাহিনী রয়েছে। এর একটি নিয়মিত বাহিনী অপরটি বিশেষ বিপ্লবী গার্ড সেনা, যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি। ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনী বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। এই গার্ড সেনারা বেশি শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত। এই বাহিনীকে সময়ের চাহিদায় আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে। ইরানের রয়েছে বিশেষ কুর্দি বাহিনী ও নেভাল বাহিনী, যারা গেরিলা যুদ্ধ করতে সক্ষম। অপর দিকে, ইসরাইলের গোপন পরমাণু কর্মসূচি মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরান ইস্যুতে সৌদি-ইসরাইল গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের রেকর্ড রয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক ও সাইবার শক্তির সরাসরি সহায়তা পাচ্ছে সৌদি আরব। ইসরাইল নিজেকে সুন্নি মুসলিমদের বন্ধু বলে প্রচার করছে।
দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যুদ্ধ হয়নি।। জিও পলিটিক্যাল ফিউচারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইল শেষ পর্যন্ত অন্য দেশের স্বার্থে ইরানের সাথে সঙ্ঘাতে জড়াবে না। ইসরাইল সবসময় এক ঝুড়িতে ডিম রাখার নীতি অনুসরণ করে না।’ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে নানা ধরনের বিভাজনের সুযোগে এক ধরনের ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে ইসরাইল। দুই দেশেরই আছে দূরপাল্লার যুদ্ধবিমান, যুদ্ধাস্ত্র, সাবমেরিন, নৌ বাহিনীর ছোট যুদ্ধবিমান এবং শক্তিশালী সব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। স্থল যুদ্ধ ও পরিবহনের জন্য ইরানি বাহিনীতে আছে আধুনিক যুদ্ধ হেলিকপ্টার। ২০১০ সালের পর ইরান ও ইসরাইল উভয় অনেক মারাত্মক সব অস্ত্র নির্মাণ ও ক্রয় করেছে। ইরান ড্রোন বিমান তৈরি করেছে, নতুন নতুন যুদ্ধ জাহাজের প্রবেশ ঘটিয়েছে। ইরানের রয়েছে নতুন যোগাযোগব্যবস্থা, ভিন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থা, শক্তিশালী রাডার ব্যবস্থা, নতুন স্যাটেলাইট ব্যবস্থা, মনুষ্যহীন আকাশ যান বা ড্রোন। সমর বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের কাছে রয়েছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সবচেয়ে বড় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংগ্রহ।

No comments

Powered by Blogger.