মানুষ হওয়ার সংগ্রাম by মো: গোলাম হোসেন

‘দেশপ্রেমের শপথ নিন, দুর্নীতিকে বিদায় দিন’ ডেসকোর বিদ্যুৎ বিলের উপর লাল কালিতে লেখা আবেদনটি গ্রাহকদের নজরে পড়ার কথা। এ ধরনের আবেদন ও সতর্কবাণী ঘুষ ছাড়া কাজই হয় না এমন দফতরে দৃষ্টিগোচর হয়। ‘বখশিশ’ ছাড়া কাজই হয় না এমন এক দফতরে ঘুষবিরোধী নানা উপদেশবাণীর পাশাপাশি ঘুষখোরদের পোড়ানো হবে এমন একটি দোজখের কাল্পনিক চিত্রও দেয়ালে সাঁটা দেখতে পেলাম। কোনো কোনো দফতরে ঘুষ ও দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন হাদিস যেমন ‘হারাম অর্থে গঠিত, রক্ত মাংস বেহেশতে প্রবেশ করবে না’, ‘ঘুষদাতা-গ্রহীতা দু’জনই সমান অপরাধী’ ইত্যাদি সযত্নে উৎকীর্ণ হতে দেখা যায়। চরিত্র গঠনমূলক এই বাণীগুলো শিশু-কিশোরদের ছাত্রজীবনেই তালিম দেয়ার কথা থাকলেও এখন বাবা-মায়েদের তালিম দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সুতরাং দুর্নীতি তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছে রাজ ভয়, লোক ভয় আর নরকের ভয় উপেক্ষা করেই। দুর্নীতি এখন যে অপ্রতিরোধ্য ভয়াল রূপ নিয়েই আছে, তার স্বীকৃতি এবার পাওয়া গেল মন্ত্রীর মুখেই। এই স্বীকৃতির রাজনৈতিক ব্যাখ্যা যাই হোক, আমরা মনে করি, এর একটি ইতিবাচক দিকও আছে। আর তা হলো- সরকার হয়তো এ বিষয় আর ছাড় দেয়ার পক্ষে নেই। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্যে তেমনি একটি আশার আলো দেখা গেল যেন। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ যখন সবারই কাম্য, তখন দুর্নীতি নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে ‘জাতীয় কালচারে পরিণত কেন’ তা অনুধাবন খুব জটিল ও কঠিন বিষয় নয়। সম্ভবত আমরা নীতিগতভাবে যতটা দুর্নীতিবিরোধী, আত্মস্বার্থ চেতনার মোকাবেলায় তার চেয়ে অধিক দুর্নীতি সহনশীল।  দেশকে মধ্যম আয়ে উন্নীত করা সরকারের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ার মূল কারণ যে দুর্নীতি, এ উপলব্ধি বোধ করি এখন কাজ করছে অনেকের মধ্যেই। গত ১০ ডিসেম্বর দুর্নীতিবিরোধী দিবসের এক সমাবেশে দুর্নীতিবিরোধী যে কঠিন উচ্চারণ দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কণ্ঠে শোনা গেল, তা গতানুগতিক নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস। তার ভাষায়, ‘আমাদের সমাজে দুর্নীতিবাজ নামক শকুনের উদ্ভব হয়েছে। আমরা এদের উৎখাত করতে চাই। ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি সেবা নিতে ঘুষ, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে দুর্নীতিবাজরা নগ্নভাবে তাদের ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে, তাদের বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে। আমরা দলমত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে তাদের উপযুক্ত জবাব দিতে চাই। প্রায় একই সময় শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ তার দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে নিজ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে অনেকটা আবেগতাড়িত অনন্যোপায়ের মতো কিছু কথা বলেছেন, যা সমালোচনার কারণ হয়েছে। আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, ঘুষ খান কিন্তু সহনীয় মাত্রায় খান। কেননা আমার এটা বলার সাহস নেই যে, ঘুষ খাবেন না। তা অর্থহীন হবে। খালি যে অফিসাররাই চোর, তা না, মন্ত্রীরাও চোর, আমিও চোর। জন্মগত এমনই চলে আসছে। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের একটি শুভ ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, স্বীকৃতি আছে দুর্নীতির ব্যাপকতার যা দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সাথে মিলে যায়। ‘মন্ত্রীরাও চোর, আমিও চোর’ তার এই উক্তির যথার্থ ব্যাখ্যা মেলে তার কথাতেই।
‘আমার মন্ত্রণালয়ের কাউকে যদি চোর বলা হয়, তবে মন্ত্রী হিসেবে আমিও চোর হয়ে যাই।’ এ চেতনার সাথে দ্বিমতের অবকাশ কোথায়? শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতির অভিযোগ অনেকটা ঐতিহ্যগত। আমার প্রথম চাকরি শিক্ষা অধিদফতরেই। অভাব-অনটনের চাপে ছাত্রজীবন শেষ না করেই চাকরি নিয়েছিলাম। সেই ১৯৭১ সালের কথা। বয়স দিন কয়েক কম থাকার পরও চাকরি হয়েছিল কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন ছাড়াই। তবে সুপারিশ লেগেছিল বয়স কমের জন্য। আর সুপারিশকারী ছিলাম নিজেই। অবশ্য চাকরিটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করেছিল। নাহিদের ‘খাম তত্ত্বের’ সত্যতা সে যুগেও যে ছিল না তেমন নয়। বড় সাহেবদের বাসায় ‘পুকুরের ইলিশ’ নিয়ে যাওয়ার গল্প তখনো শোনতাম। বড় বাবুদের সারপ্রাইজ ভিজিটের গোপন খবর এখনকার প্রশ্ন ফাঁসের মতোই পৌঁছে যেত জায়গা মতো। ন্যায্য টিএ বিলটাও ঘুষ না দিয়ে পাওয়া যেত না। অনেকে বলেন, ঘুষ ব্রিটিশ আমলেও ছিল। কিন্তু কথা হলো, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীর পরও এই ব্যাধির নিরাময় তো দূরের কথা, বরং মহামারির আকারে কেন? শিক্ষামন্ত্রীর আবেগপ্রবণ বক্তব্যের অনেকে কঠোর সমালোচনা করেছেন না বোঝেই হয়তো। একজন মন্ত্রী এমনও বললেন, ‘নাহিদ চোর হতে পারেন, আমরা চোর নই। তার দফতরে চুরি বা দুর্নীতি না থাকলে এই দাবি তিনি করতে পারেন অবশ্যই। দেশের উন্নয়ন ও আইনের শাসন কায়েম নিশ্চিতকরণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিকে ‘স্পিড মানি’ বলে স্বীকৃতি দেয়ার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি ‘আমরা লুটপট করে খেলেও কাজ করেছি’ বলে বাগাড়ম্বর আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা অর্থহীন নয়, পদমর্যাদার সাথে বেমানান তদুপরি বেআইনিও। আমরা মনে করি, দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন তা সময়োচিত। এ জন্য প্রয়োজনে উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে সর্বদলীয় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.