আপস করার জায়গা নেই by মাসুদ মজুমদার

বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ যে ঝড় বয়ে গেল এর স্থিতি কতক্ষণ তা কেউ জানেন না। এটা শুধু একজন নেত্রীর শাস্তি বা কারাবাস নয়, এর সাথে রাজনীতির অনেক গুণগত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। কিছু গুণগত পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে। এমন হতে পারে, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাত থেকে সরে যেতে পারে। বিএনপিকে এখন মামলার পাহাড় ডিঙাতে হবে। আন্দোলন ও আইনি লড়াই চালাতে হবে। রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে হবে। এই মোকাবেলা হবে অসম। কারণ, ক্ষমতা ও প্রশাসন এক পক্ষে অবস্থান নিয়েই আছে, এই অবস্থায় মাঠ সমতল পাওয়ার কোনো ভরসা নেই। একজন নেত্রীর কারাবাস অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, এর ইতিবাচক-নেতিবাচক পরিবর্তন অবশ্যই হবে। ঝড়ে অনেক গাছের ডাল ভাঙে। অনেক গাছ উপড়ে পড়ে যায়। অনেক নদী গতি পরিবর্তন করে। সব চেয়ে বড় প্রভাবটা পড়ে মানুষের মনোজগতের ওপর। মানুষ এমন কোনো ভাবনায় জড়িয়ে যায়- যা একসময় ভাবতে চায়নি। অনেক চিন্তা করে, যা গতানুগতিক অবস্থায় করা হতো না। যেমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক ধরনের মেরুকরণ দেখা দেবে; যা গতানুগতিকভাবে হওয়ার কথা ছিল না। এমন মেরুকরণ হবে, যা গতানুগতিকভাবে হতো না। এমন সব ঘটনা ঘটবে, যা একসময় ঘটার কথা ছিল না। এখন ভবিষ্যদ্বাণী করে বলা সম্ভব নয়, বাস্তবে কেমন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি একটা সময় অতিক্রম করে সব সময় ধারা পাল্টায়, ডান বাম হয়ে যায়, বাম ডান হয়ে পড়ে। মধ্যপন্থী চরমপন্থী হয়ে পড়ে। এই নজির নতুন নয়।
আখেরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটবে, যা এখন ভাবা কঠিন ও দুঃসাধ্য। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা পাল্টে দিয়েছে। সেটা সাধারণের ভাবনার মধ্যে ছিল না। সাধারণ ভাবনায় ছিল- মুক্তিযুদ্ধ শেষে রাজনীতির শ্রেণিচরিত্র পাল্টে যাবে। অবশ্যই শ্রেণিচরিত্র পাল্টেছে; কিন্তু কারো তত্ত্ব অনুযায়ী হয়নি। কারো যোগবিয়োগ অনুযায়ী হয়নি। কারো ধারণাকে ধারণ করে হয়নি। যা কিছু হয়েছে জনগণের ভাবনার বাইরে হয়ে গেছে। জনগণ বাম ভাবনার প্রতি কখনো সংবেদনশীল ছিল না। এটা এই মাটির ধর্ম। এর সাথে ধর্মবিশ্বাস মানুষকে বাম হতে উৎসাহিত করে না। এর মূল কারণ, বাম রাজনীতি ধর্মকে প্রতিপক্ষে রেখে নিজেদের রাজনীতি করতে চেয়েছে। একসময় চরম বামপন্থীর উত্থান ঘটল। সেই বামপন্থী জাতীয়তাবাদী ধারাকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিলো, জাতীয়তাবাদী ধারা খোলস পাল্টে, ধারা পরিবর্তন করে নতুন এক অবয়ব পেল; যা জনগণ চায়নি; কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে। বামপন্থী রাজধানীর মড়ক লাগবে- এটা কি কেউ ভেবেছেন? রাজনীতিতে রাজনৈতিক ইসলাম জায়গা করে নেবে। তা-ও কি কারো ভাবনার ভেতর ছিল, নিশ্চয় ছিল না। এক-এগার রাজনীতি পঁচাত্তরের মতো তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন আনেনি; কিন্তু রাজনীতির মাঠে দু’টি স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করল, সেই স্রোত কেউ পরিকল্পনা করে শুরু করল না। কিন্তু কোনো কোনো মানুষ যেন প্রাকৃতিক পরিকল্পনার মধ্যেই পড়ে গেল, দেশে দেদার দুর্নীতি চলছে। কেউ কথা বলছে না। নানা ধরনের কেলেঙ্কারি চলছে কেউ চিৎকার করে বলছে না- এসব থামাও, বন্ধ করো। যারা বলছেন, তারা এ সময়ে এসে মৃদুকণ্ঠ। ওই মামলা হচ্ছে- সবাই জানে এর রাজনৈতিক চরিত্র কী, কিন্তু যেভাবে চিৎকার করে বলা প্রয়োজন তা কি কেউ বলছেন- ঠিক বিচার আচার নিয়ে কেউ প্রাণ খুলে কথা বলেন না।
আইনি বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়ার দায়ও কারো নেই। সবাই এমন সব ভাষায় কথা বলছেন, যেমন এটাও হতে পারে- ওটাও হতে পারে। আইন কেন দ্বিধান্বিত ব্যাখ্যায় হবে। আইনের একক ব্যাখ্যা থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ধরনের কোনো স্বাভাবিকতা কোথাও লক্ষ করা যাবে না- না টক শো শোতে, না রাজনৈতিক বিতর্কে। এটাকে সুবিধাবাদ- আশ্রয়ী সময় বলা হবে কি না, জানি না। তবে যারা মামলা নিয়ে মাতম করেন, জেল জুলুম নিয়ে কান্না করেন- তারা রাজনীতির পোক্ত খেলোয়াড় নন, রাজনীতিতে এক পক্ষ কাঁদে, অন্য পক্ষ বগল বাজায়। তাহলে ঝড় যে অদৃশ্য একটি বিষয় জন্ম দিয়েছে সেটি ভীতি, ক্ষতি, লোভ। এই ভীতি নিজের অস্তিত্বের ভীতি, এই ক্ষতি নিজের অস্তিত্বের ক্ষতি। এই লোভ নিজের প্রাপ্তিযোগের অংশ। এখানে সমাজের মোহ, ক্ষমতার আশীর্বাদ, নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা, ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখার মোহটা মোক্ষম। এ লেখার উদ্দেশ্য কাউকে রাজনৈতিক সবক দেয়া নয়। রাজনীতিতে যে ভাঙা-গড়া শুরু হয়েছে, যে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে, যে ভাগ-বিভাজন চলছে, তার একটা উপসংহার চাই। এটার জন্য রাজনৈতিক শক্তির দায় একক নয়। সামাজিক শান্তির দায়টাও বড় হয়ে এসেছে। সুশীলসমাজকে সামনে বাড়াবার তাগিদ দিচ্ছে, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষক সবাইকে ভাবতে হবে- এ সময়টা পাল্টাবে, এই সমাজটা পাল্টাবে। এই রাজনীতি পাল্টাবে। এই অবস্থা পাল্টাবে। সেই পাল্টানোর সময় যে যার ভূমিকা পালন না করে বসে থাকার সুযোগ পাবেন না। সময় সেই সুযোগ দেবে না। সেই সুযোগ বলে কয়ে আসবে না। জানান দিয়ে আসবে না। এটা ঠিক, রাজনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়া জরুরি, সেটা অতি প্রাকৃতিক নিয়মেই হবে- এমনটি নয়, রাজনীতিবিদদের চেষ্টায়ই সেটা হওয়া সম্ভব। সব জাতির ইতিহাসে একটা সময় আসে- যখন অনেক কিছু পাল্টে যায়, স্রোত পাল্টে যায়, রাজনীতির স্লোগান পাল্টে যায়। সেই সময় কে কোন ভূমিকা পালন করবেন- সেটা নির্ণয় করার সময় এখনই। কারণ, সময়টা বহতা নদীর মতো। এটা চলছে, চলবে।
থামবে যেখানে- সেখানে পলি মাটির স্তূপ পড়বে। সেটাই হবে আগামী দিনের রাজনীতির পুঁজি। সেটা নিয়ে সবাই ভাবতে হবে। আজকের রাজনীতিটাকে খালেদা জিয়ার ও শেখ হাসিনার হার জিতের মধ্যে ভাবলে ভুল করা হবে। এর সাথে আধিপত্যের সংযোগ আছে, আঞ্চলিক রাজনীতির পাঠ আছে, বিশ্বরাজনীতির যোগ-বিয়োগ আছে, বিকাশমান পুঁজির সংযোগ আছে। সে সংযোগ শুধু রাজনীতির হাতের পুঁজি নয়। ভূরাজনীতির খেলাও সংশ্লিষ্ট। তাই বাংলাদেশ পুরোটা এখন রাজনীতির একটা উপাত্ত, পুরো মানচিত্রটা একটা মাঠ, এই মাঠে দাবা খেলা আছে, পাশা খেলা আছে, আছে বিকশিত পুঁজির ভাগ, বিভাজনের খেলা। তাই নেত্রীর কারাবাস দীর্ঘতর হলো কি সংক্ষিপ্ত হলো, তা কিভাবে মুখ্য হয়? হ্যাঁ, রাজনীতির সিমপ্যাথি খালেদা জিয়া পেয়েছেন, এবারো পেলেন। তার ওপর জুলুম বাড়লে তা আরো পাবেন। এই খালেদাকে যারা চেনেন স্বৈরশাসকবিরোধী রাজনীতির একজন মাঠের নেত্রী লড়াকু সৈনিকরূপে, তাদের কাছে এই নেত্রী অন্য ধাতুতে গড়া। সেই ধাতু রোদে পুড়বে, জেলে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করে কষ্টের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তিনি সঞ্চিত পুঁজি ‘আপসহীনতা’র তকমাটা কাউকে বন্ধক দেবেন না। তার এই পথচলা কোথায় থামবে- সেটা বড় কথা নয়। সব চেয়ে বড় কথা তিনি যে আপসহীনতার অর্থ বুঝেছেন- সেখানে ছাড় দেবেন বলে মনে হয় না।
masud2151@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.