মিয়ানমারের গণহত্যাকে হোয়াইটওয়াশ by রামজি বারুদ

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, তা মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। কিন্তু মিডিয়ার বৃহত্তর পরিসরে বিষয়টি আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো অর্থপূর্ণ পথে বা স্বেচ্ছায় যে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তুত, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, দেশ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্ত শিবিরগুলোতে আটকা পড়ে আছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী ও বৌদ্ধ মিলিশিয়ারা রোহিঙ্গাদের ওপর যে ব্যাপক বর্বরতা চালিয়েছে, পদস্থ জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তারা তাকে এখন ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু এই গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো পরিকল্পনা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ২০১৭ সালের আগস্টের শুরু থেকে ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই বছর সময়সীমার মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। একই সময়ে ছয় লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে অথবা তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূল অভিযানকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নাম দিয়েছে- ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস।’ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ারস জানায়, গণহত্যা অভিযানের প্রথম মাসেই বহু রোহিঙ্গা মুসলিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট ও ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৯ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭৩০টি শিশুও রয়েছে। রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের এরিক শোয়ার্টজ আমেরিকান ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর (এনপিআর) সাথে এক সাক্ষাৎকারে ‘এসব ঘটনাকে সাম্প্রতিক সময়ে একটি বড় অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জোরপূর্বক ভিটেমাটি ছাড়ানো একটি বৃহত্তম অপরাধ।’ ব্যাপক গণধর্ষণ, সরাসরি হত্যা, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ব্যাপকভাবে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া এবং অবর্ণনীয় নৃশংসতা ও বর্বরতার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনভাবে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি দেয়া হয়নি। মিয়ানমারে তাদের কোনো আইনগত মর্যাদা দেয়া হয়নি। তাই তাদের ফিরে যাওয়াটা পালিয়ে আসার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ।তাদের কোনো প্রোটেকশন বা মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা ছাড়াই উদ্বাস্তুদের ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে মিয়ানমার সরকারের অপরাধের ‘হোয়াইটওয়াশ’ বা অপরাধ দেবে রাখার ব্যাপারে একটি বৃহত্তর প্রচারণার অংশ।
এটা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বিধান বা তাদের সুরক্ষা দেয়ার বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের ভিন্নমতেরই পুনরাবৃত্তি। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার কয়েক দশক ধরে বর্বরতা ও নৃশংসতা চালিয়ে আসছে। ২০১২ সালে তারা নতুন করে জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করে। ওই সময় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নিজেদের গ্রাম এবং শহরগুলো থেকে জোরপূর্বক বের করে দিয়ে কারাগারের মতো কথিত অস্থায়ী উদ্বাস্তুশিবিরে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে এক লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করা হলো। গত বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের এ নৃশংসতা অব্যাহত ছিল। এরপর সরকারের সব নিরাপত্তা শাখা জাতিগত নির্মূল অভিযানে সম্পৃক্ত হয়ে গণহত্যায় মেতে ওঠে। সু চি এবং তার দেশের সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই জরুরিভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) সোপর্দ করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর জন্য সরাসরি দায়ী করে তাদের আটক করতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো এই সহিংসতা ও বর্বরতার প্রতি অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের কর্মকর্তারা নির্লজ্জ সমর্থন জানিয়েছেন। সু চিকে কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা মিডিয়া এবং সরকারগুলো গণতন্ত্রের আইকন ও মানবাধিকার হিরোইন হিসেবে স্বাগত জানিয়ে আসছিল। যা হোক, সু চি গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে ২০১৫ সালে মিয়ানমারের নেত্রী হয়ে ওঠার সাথে সাথে তিনি তার সাবেক সামরিক শত্রুদের রক্ষা করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সহিংসতার নিন্দা করতেও অস্বীকৃতি জানান। তিনি এমনকি ঐতিহাসিকভাবে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের ‘রোহিঙ্গা’ নাম ব্যবহার করতেও অস্বীকৃতি জানালেন। সু চি সামরিক বাহিনীর অব্যাহত নির্যাতন ও সহিংসতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। এখনো বিশ্বব্যাপী তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তার ন্যায়বিচারের নৈতিক চেতনার আবেদনের প্রতি খুব বেশি জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে সরকার ও সামরিক বাহিনীর অপরাধের বিরোধিতা করার জন্য কোনো নীতি বা কৌশল প্রণয়ন করা হয়নি। ‘আসিয়ান’ নেতারা অথবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেউ এ ধরনের কোনো নীতি বা কৌশল প্রণয়ন করেননি। এর পরিবর্তে জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত অপর একটি উপদেষ্টা পরিষদের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য দায়সারা গোছের ‘আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ড’ গঠন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, উপদেষ্টা বোর্ড কিছুই প্রমাণ করবে না; বরং তারা সামরিক বাহিনীর অপরাধকে হোয়াইটওয়াশ বা অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মার্কিন মন্ত্রিসভার সাবেক মন্ত্রী ও পদস্থ কূটনীতিক বিল রিচার্ডসন যিনি সম্প্রতি বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন- তিনিই বাস্তবে এ মূল্যায়ন করেছেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘আমার পদত্যাগ করার প্রধান কারণ হচ্ছে- উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা একটা হোয়াইটওয়াশ মাত্র। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘সরকারের জন্য একটি আনন্দদায়ক স্কোয়াডের’ অংশ হতে চাই না। রিচার্ডসন ‘নৈতিক নেতৃত্বের ঘাটতি বা দুর্বলতার জন্য সু চিকে দায়ী করেছেন। সু চিকে তার নৈতিক ব্যর্থতার জন্য অবশ্যই জওয়াবদিহি করতে বাধ্য করা উচিত। সু চির নেতৃত্বের অবস্থান বা মর্যাদা বিবেচনা করে অবশ্যই তার পদস্থ নিরাপত্তা ও সেনাপ্রধানের সাথে একত্রে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তাকে সরাসরি দায়ী করা উচিত। মানবাধিকার গ্রুপের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন জাতিসঙ্ঘ মিয়ানমারকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে পেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি। কারণ, মিয়ানমার রোমের সংশ্লিষ্ট বিধিবদ্ধ আইনে স্বাক্ষরকারী নয়। তাই এ ধরনের রেফারেন্স পেশ করা হচ্ছে রাষ্ট্রটিকে আইসিসির কাছে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। এ পদক্ষেপ আইনগতভাবে সমর্থনযোগ্য ও জরুরি। কারণ, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও সহিংসতা চালিয়েছে, সেজন্য অনুতপ্ত নয়। রবার্টসন ‘টার্গেট করা অবরোধ’ আরোপের আহ্বান চালিয়েছেন। এ অবরোধের ফলে দেশের ধনী ও ক্ষমতাশালী এলিটদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে এবং এতে করে সামরিক বাহিনী ও সরকারের ওপর তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় মিয়ানমার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে তাদের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেয়ার অনুমতি পেয়েছে। মিয়ানমারে ইতোমধ্যেই শত শত কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০১৮ সালে দেশটিতে ছয় শত কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এশিয়ায়, পশ্চিমা বিশ্বে এবং বিশ্বের অবশিষ্ট অনেক দেশের পক্ষ থেকে এটাকে নৈতিক ব্যর্থতার একটি বড় নজির হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের গোটা সম্প্রদায়কে যেখানে হত্যাযজ্ঞ ও বর্বর নির্যাতন চালিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছে- যেখানে মিয়ানমারকে অবশ্যই পুরস্কৃত করা উচিত নয়। মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ এবং সু চিসহ মিয়ানমারের নেতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া এবং তাদের আইসিসির কাছে পেশ করা না গেলে রোহিঙ্গা গণহত্যা কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না- এই গণহত্যা অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক ও গ্রন্থকার। ফিলিস্তিন ক্রনিকলের সম্পাদক। ফিলিস্তিন বিষয়ের ওপর ডক্টরেট।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.