ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অব্যাহত অগ্রযাত্রা

ইরানের ইসলামি বিপ্লব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিপ্লব। তাই এ বিপ্লব ইরানি জাতিসহ গোটা  মুসলিম উম্মাহ ও মানব জাতির জন্যেও গৌরবের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ, এ বিপ্লব বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিসহ জালিম শক্তিগুলোর জন্য এখনও সবচেয়ে বড় আতঙ্কের কারণ।  ইরানের ইসলামি বিপ্লবের শক্তি ও প্রভাবের উৎস হল সত্যের আহ্বান এবং সত্য ধর্মের প্রকৃত ধারক ও বাহকদের রেখে-যাওয়া আদর্শ আর তাদেরই অনন্য সংগ্রামের ধারাবাহিকতা।
অন্য কথায় এ বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনী (র)’ র আহ্বান ছিল হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত এমন এক আহ্বানের প্রতিধ্বনি যা উচ্চারিত হয়েছিল ইসলামের মহানায়কদের কণ্ঠে। এ বিপ্লব কাবিলের সঙ্গে হাবিলের, নমরুদের সঙ্গে হযরত ইব্রাহিমের, ফেরাউনের সঙ্গে হযরত মুসার, আবু জাহিল ও আবু লাহাবের মত কাফির-মুশরিকদের সঙ্গে বিশ্বনবীর (সা)র সংগ্রাম এবং ইয়াজিদসহ মুসলিম নামধারী স্বৈরশাসকদের সঙ্গে মহান ইমামদের দ্বন্দ্ব ও তাঁদের আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতার ফসল।  ইসলামের এই অতুলনীয় শক্তির বলেই মুসলিম বিশ্বে  মার্কিন সরকারের সবচেয়ে বড় মিত্র শাহের সরকারকে উৎখাত করেছিলেন ইমাম খোমেনী (র)। সেনা ও সামরিক শক্তির দিক থেকে শাহের সশস্ত্র বাহিনী ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ শক্তি।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব আলোর এক অনন্য বন্যা এবং মানবীয় ও ইসলামি শক্তির অফুরন্ত বিস্ফোরণ! অনেক প্রতিকূলতা আর বাধা সত্ত্বেও অনবদ্য ও অভূতপূর্ব নানা সাফল্যের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে ক্রমেই এগিয়ে নিচ্ছে বৈশ্বিক এক মহাবিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্যগুলোর ভিত্তি প্রতিষ্ঠার দিকে। যে লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হলে বিশ্বে থাকবে না অজ্ঞতা ও পাপাচারের আঁধার; থাকবে মানবিকতা ও ন্যায়বিচারসহ সবগুলো সুন্দর মূল্যবোধের অশেষ আলো এবং স্বাধিকারহারা মানুষেরা ফিরে পাবে তাদের সমস্ত অধিকার। তাই এরইমধ্যে  বিশ্বের নানা অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা আন্দোলনের জন্য এ বিপ্লব পরিণত হয়েছে এক আদর্শ গাইড বা অনুকরণীয় মডেলে।
ইমাম খোমেনী (র.)’র নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ঘটায় টাইম ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছিল যে, গোটা মুসলিম উম্মাহ জেগে উঠছে এবং তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব জাতিগুলোর প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় সূচিত করেছে। কারণ, এ বিপ্লব কেবল ইরানেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে  তাগুতি ও সাম্রাজ্যবাদের শীর্ষস্থানীয় এক অনুচর রাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করেনি। এ বিপ্লব প্রাচ্যও নয়, পাশ্চাত্যও নয়-বরং ইসলামই শ্রেষ্ঠ-এই নীতির আলোকে আধিপত্যকামী শক্তিগুলোসহ বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও এক বলিষ্ঠ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাই এ বিপ্লবের আবেদন কোনো বিশেষ অঞ্চলে সীমিত থাকেনি।
ফিলিস্তিন, বসনিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও কাশ্মিরের মজলুম জনগণসহ মুক্তিকামী জাতিগুলোর কাছে ইরানের ইসলামি বিপ্লব হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। এইসব কারণেই গত প্রায় চার দশক ধরে এ বিপ্লব নব্য-উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জন্য প্রধান আতঙ্ক হয়ে বিরাজ করছে। খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের পতাকাবাহী এ বিপ্লব ইসলামি আইন, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কখনও বিন্দুমাত্র আপোষ করেনি। জালিমের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামি সরকারের কঠোর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এবং মজলুমের পক্ষে সর্বাত্মক সাহায্য ও সমর্থনই এই বাস্তবতার বড় প্রমাণ।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী বিশ্ববাসীর কাছে এটা তুলে ধরেন যে মার্কিন সরকার হচ্ছে ইসলামের এবং জাতিগুলোর স্বাধীনতা ও উন্নতির প্রধান শত্রু। তাই তিনি মার্কিন সরকারকে বড় শয়তান বলে অভিহিত করতেন। দেশে দেশে মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসন ইমামের সেই দূরদর্শী ঘোষণার যাথার্থতাকে দিনকে দিন আরও স্পষ্ট করছে।
আজ সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন সরকার, পাশ্চাত্য ও তাদের ইহুদিবাদী দোসরসহ নানা তল্পিবাহক সরকারগুলোর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার অন্যতম প্রধান কারণ হল ইরানের ন্যায়বিচারকামী প্রতিরোধের নীতি। এক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে অপরাজেয় শক্তি বলে বিবেচিত দখলদার ও বর্ণবাদী ইসরাইল লেবাননের হিজবুল্লাহর হাতে বার বার নাজেহাল হয়েছে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সহযোগিতার কারণেই। ফিলিস্তিনের গাজা ইসরাইলি নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছে ইরানের সহযোগিতার কারণেই। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সাফল্যের অনুপ্রেরণাই পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের আগুন ও স্বাধীনতার দুর্বার আশা জিইয়ে রেখেছে
ইরানের ইসলামি বিপ্লবীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আজ বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রতিরোধ সংগ্রামীরা বলছেন, প্রতিটি দিনই আশুরা ও প্রতিটি ময়দানই কারবালা কিংবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ- ধ্বংস হোক্‌ নিপাত যাক্‌
সামরিক শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা ক্ষেত্রেও ইসলামি ইরান আজ আলোচনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। সামরিক শক্তিতে ইরান আজ এত উন্নত যে শত্রুরা সাদ্দামকে দিয়ে ইরানে হামলা চালানোর যুগের পর কখনও ইরানে প্রকাশ্যে কোনো অভিযান চালানোর কথা চিন্তাও করতে পারেনি। ইরান নিজের তৈরি একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে মহাকাশে।
ইরান আজ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের শহরগুলোতে একজন যুবতীও গভীর রাতে চলাফেরা করতে পারেন নিরাপদে। ইরানের আশপাশের নানা রাষ্ট্রে বিদেশী মদদে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস এবং জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়মিত বিষয় হয়ে থাকলেও ইসলামি এই রাষ্ট্রে এসবের লেশমাত্রও নেই। ব্যবসায়ী, পুঁজি-বিনিয়োগকারী, বিদেশী পর্যটক এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকসহ সব শ্রেণীর জনগণের জন্য নিরাপত্তার দ্বীপ হল ইরান।
বিশ্বের সবচেয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অধিকারী হল ইরান। দেশটি আজ পরিপূর্ণ অর্থেই স্বাধীন। ইসলামি এই দেশটির ক্ষমতার কাঠামো, রাজনীতি ও সংস্কৃতি বাইরের শক্তিগুলোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত নয়।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বয়স এক বছর না পেরোতেই সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট বাথিস্ট সাদ্দামকে দিয়ে চাপিয়ে দেয়া হয় ইরানের ওপর যুদ্ধ। ৮ বছরের সে যুদ্ধে রাজতান্ত্রিক আরব সরকারগুলোসহ বিশ্বের ২৬টি দেশ ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় ইরান।
সাম্রাজ্যবাদের প্রধান মোড়ল মার্কিন সরকার, আগ্রাসী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকার যেসব কঠোর ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল, বিশ্বের অন্য কোনো সরকার তেমন পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেনি।
এটা স্পষ্ট শিয়া-সুন্নি বিভেদের কৃত্রিম সংকট উস্কে দিয়ে ও তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিয়ে পাশ্চাত্যের জড়বাদী সভ্যতা তার পতন ঠেকাতে পারবে না। পাশ্চাত্যের নানা সংকট, দেশে দেশে মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ এবং নানা ক্ষেত্রে ইরানের অব্যাহত বিজয়ই এর প্রমাণ। মহান আল্লাহই বলেছেন, আল্লাহ তাঁর ধর্ম ও নূরকে ছড়িয়ে দেবেন, তা কাফিরদের কাছে যতই অপছন্দের হোক না কেন।

No comments

Powered by Blogger.