'সংগ্রাম না করলে সামনে এগোনো যায় না'

কখনো স্কুলে যাননি প্রাকাশি টোমার। অর্থাৎ তার নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তার পরও তিনি লড়াকু নারী। তিনি সবার কাছে পরিচিত ‘শুটার দাদি’, ‘রিভলবার দাদি’ ইত্যাদি নামে। তবে বেশি পরিচিত শুটার দাদি নামে। পেয়েছেন মেডেল, ট্রফি ইত্যাদি। তিনি এখন ভারতের একজন তুখোর নারী শুটার। জন্ম ১৯০৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে। আর বসবাস করছেন উত্তর প্রদেশের বাগপাত এলাকার জোহরিতে। তার বয়স এখন প্রায় ৮১ বছর হলেও যৌতুকলোভীরা এখনো তাকে প্রচণ্ড ভয় করে। কারণ তিনি যৌতুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কারণ হাতে থাকে বন্দুক। প্রায় ২১ বছর যাবৎ তিনি বন্দুক চালান। তিনি মনে করেন, যে করেই হোক সমাজ থেকে যৌতুক নির্মূল করতে হবে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। ভারতের বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে যৌতুকপ্রথা চরম আকার ধারণ করেছে। এর বিষবাষ্প থেকে সেখানকার নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অনেকে হত্যারও শিকার হয়েছেন। প্রাকাশি বলেন, ‘আমি চাই, আর কোনো মেয়ে যৌতুকের ছোবলে না মরে। এর বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে।’ তিনি মনে করেন, এমন কিছু আমাকে করতে হবে, যাতে যৌতুকলোভীরা আমার কথা শুনলে চুপসে যায়। অবাক বিষয় হচ্ছে, তার গ্রামে এখন আর যৌতুক চাওয়া হয় না মেয়ের বিয়ের সময়। যৌতুকের প্রসঙ্গ উঠলে অনেকে ভয়ে বলে, যৌতুক চাইলে গুলি করে মারবে দাদি। অনেকে এখন তাকে শুধু ভয়ই করে না, সম্মানও করে। কারণ তিনি সম্মান পাওয়ার মতো কাজ করেন। প্রাকাশি শুটিংয়ের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন বুড়ো বয়সে। এতে তিনি প্রায় শতভাগ সফল হন। এক দিন তিনি শুটিং রেঞ্জে যান তার নাতনিদের সঙ্গে। সেখানে গিয়ে তিনি শুটিংয়ের প্রতি আগ্রহী হন এ সংক্রান্ত কলাকৌশল দেখেন। তিনি মনে করতেন, এতে ভর্তি হলে তিনি সফল হবেন। তিনি শুটিং রেঞ্জে যেতে থাকেন নিয়মিত। তার আগ্রহ এবং টার্গেট দেখে (প্রশিক্ষণের) একদিন তাকে বন্দুক চালাতে বলেন সেখানকার প্রশিক্ষকেরা। এ জন্য লক্ষ্যবস্তু স্থির করে নিশানা করতে বলা হয়। তার বন্দুক চালানো অর্থাৎ নিশানা দেখে প্রশিক্ষকেরা বুঝতে পারেন, এতে তিনি ভালো করবেন।
শুটার দাদি বলেন, ‘এই ভারী বয়সে যদি আমি এ বিষয়ে ভালো না করতাম তবে মানুষ আমাকে ঠিকই তিরস্কার করত, হাসি-তামাশাও করত। আমি তা করতে দেইনি। আমি এখন একজন প্রতিষ্ঠিত শুটার। এখন তাকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। তাকে নিয়ে অনুষ্ঠানও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন টেলিভিশনে। তা দেখে অনেকে বিশেষ করে নারীরা এতে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। তারা মনে করেন, এই বয়সে তিনি পারলে আমরাও পারব। অনেকে বলেন, তিনি পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে ভালোই করতেন। কোচ তাকে শুটিং রেঞ্জে সপ্তাহে এক দিন যেতে বললেও বাকি দিনগুলোতে বাসায়ই প্রশিক্ষণ নিতেন নিজে নিজে। দিল্লি পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল বা ডিআইজির সাথেও প্রতিযোগিতায় নামেন তিনি। তাতে ভালো করেন প্রাকাশি। একে একে প্রায় ২৫ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন সারা দেশে। চেন্নাইয়ে ‘ভেটারেন শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ’ নামক প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল জেতেন। একপর্যায়ে তিনি পান ‘স্ট্রি সাকতি পুরস্কার’। তিনি মনোনীত হন ১০০ সফল নারীর মধ্যেও। নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে ‘আইকন লেডি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। তার সন্তানরা যাতে শুটিংয়ে ভালো করতে পারে সে জন্য তিনি তাদেরকে শুটিংয়ে পারদর্শীদের কাছে পাঠান। তার মেয়ে সীমা টোমারও এতে সফল হন। ইন্টারন্যাশনাল শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশন (আইএসএসএফ) ওয়ার্ল্ড কাপ তাকে একটি শটগান সিলভার উপহার দেয়। দেশটির নারীদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম তা পান। এখন সীমা ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশনপ্রাপ্ত। শুটিংয়ে প্রাকাশি টোমারের বেশ বাধাও ছিল। সংসারও সামাল দিতে হচ্ছে তাকে। নাতি-নাতনিদেরও দেখভাল করতে হয়। তিনি বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সফল হওয়ার মজাই আলাদা। সংগ্রাম না করলে সামনে এগোনো যায় না।

No comments

Powered by Blogger.