মালয়েশিয়ার নির্বাচনের নানা দৃশ্যপট by মাসুম খলিলী

মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচন দোরগোড়ায় চলে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। আগামী ২৪ জুন চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরো ৬০ দিন থাকবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। কিন্তু জুনের মাঝামাঝি বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের কারাগার থেকে মুক্তির আগেই নির্বাচন করে ফেলতে চাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক। ফলে যেকোনো দিন নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারে। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর সামনে নির্বাচনের প্রস্তুতির আরো কিছু বিষয় বাকি রয়ে গেছে, যে কারণে তিনি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে ‘আধ্যাত্মিক আলোকচ্ছটার জন্য অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, আগামী এপ্রিল বা মে মাসেই ঘোষণা আসতে পারে নির্বাচনের ব্যাপারে। এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন বারিসান নাসিওনাল এবং বিরোধী পাকাতান হারাপান জোট নির্বাচনী আসন বরাদ্দ, বিন্যাস ও মনোনয়নের কাজ শেষ করে এনেছে। এবারের নির্বাচনকে মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে ‘অনিশ্চয়তাপূর্ণ’ নির্বাচন মনে করা হচ্ছে। সারা দেশে হতে পারে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী নাজিব নির্বাচনে জয়ী হতে সরকারে থাকার যত ধরনের সুবিধা রয়েছে, তার সবটুকু নেয়ার চেষ্টা করছেন; অন্য দিকে ৯২ বছর বয়সী নাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ তার অনেকটা শেষ ধ্যানজ্ঞান হিসেবে বিরোধী পক্ষকে জিতিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে গতিহারা মালয়েশিয়াকে ঠিক পথে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রে রয়েছে বিরোধী দলের কিছুটা হলেও দ্বিধাবিভক্তি। অতীতের অন্তত তিনটি নির্বাচনে বিরোধী জোটে থাকা ইসলামি দল ‘পাস’ এবার স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এতে বিরোধী পক্ষের মালয়ীদের ভোট ভাগ হলে এর সুবিধা যাবে সরকারি জোটের পক্ষে। আর ক্ষমতাসীন আমনো থেকে মাহাথির-মহিউদ্দিন-মুখরিজের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল পার্টি প্রিভূমি আমনোর ভোট একটি বড় অংশকে বিরোধী জোটের দিকে নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এই সমীকরণের ফলাফল কী দাঁড়াবে, বলা বেশ কঠিন। সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন বারিসানের পক্ষে রয়েছে ৩৫ শতাংশ ভোট, প্রতিপক্ষ পাকাতান হারাপানের পক্ষে ৩৯ শতাংশ এবং পাস-এর পক্ষে ২০ শতাংশ ভোট। আর ৬ শতাংশ ভোটার এখনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে দেখানো হয়েছে। জরিপ প্রতিষ্ঠান আইএমের করা, গত মাসের এই সমীক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এক বছর আগে একই সংস্থার জরিপে বিরোধী পক্ষের জনসমর্থন অনেক বেশি ছিল।
তখন বারিসানের পক্ষে ২৭ এবং বিরোধী পক্ষে ৪১ শতাংশ, আর ১৪ শতাংশ অন্য দল বা সিদ্ধান্তহীন দেখানো হয়েছিল। বাকিটা ছিল পাস-এর পক্ষে। গত এক বছরে ভোটভিত্তিক মেরুকরণ অনেকখানি সুনির্দিষ্ট অবয়ব পেয়েছে। বিরোধী জোটের চারটি দল এই প্রথমবারের মতো একই প্রতীকে এবং নির্দিষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেই ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন করবে। নির্বাচনের ফলাফল আগের যেকোনো বারের তুলনায় অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাস বিরোধী জোটে থাকলে নিশ্চিতভাবেই বলা যেত, এবার বারিসান নাসিওনাল সরকারের পতন অনিবার্য। আবার পাস সরকারি জোটে গেলে সেটিও প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ তৈরি করত। তবে এতে বিরোধী পক্ষের সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে যেত। কিন্তু পাস এখনো যে নীতি গ্রহণ করছে তা হলো, ক্ষমতাসীন দলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নির্বাচনে আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। এতে বিরোধী পক্ষের মালয়ী ভোটের একটি অংশ পাস-এর পক্ষে চলে যেতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে গ্রামীণ আসনগুলোতে। আইএমের জরিপে দেখা যায়, মালয়েশিয়ার ৫২ শতাংশ হলো মালয়ী ভোটার। বাকিদের মধ্যে ২৫ শতাংশ চীনা, ৭ শতাংশ ভারতীয় আর ৪ শতাংশ করে সাবাহ বা সারওয়াকের স্থানীয় ভূমিপুত্র। জরিপে মালয়ী ভোটারদের মধ্যে ৪০ শতাংশ আমনোকে, ২১ শতাংশ পাকাতান হারাপানকে আর ২০ শতাংশ পাসকে ভোট দিতে পারে বলে দেখানো হয়েছে। পাস যদি সত্যি সত্যিই পৃথক নির্বাচন করে, তাহলে এ ভোট কমে গিয়ে মালয়ীদের ক্ষেত্রে ১৬-১৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এতে পাস-এর সার্বিক ভোট প্রাপ্তি বর্তমান ১৪ শতাংশ থেকে ১১-১২ শতাংশে নেমে আসবে। আর সেলাঙ্গর, পেনাং, পেরাক ও জোহুরের মতো মিশ্র রাজ্যগুলোতে পাস-এর আসন শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে পারে। কেলানতান ও তেরাঙ্গানুর মতো রাজ্যগুলোতেও কমে যেতে পারে পাস-এর আসন। এবার তাদের সরকারবিরোধী মনোভাবের ভোট নিশ্চিতভাবেই যাবে পাকাতান হারাপানের দিকে। এতে পাকাতানের ‘পপুলার ভোট’ বেড়ে যেতে পারে। মাহাথিরের পার্টি ‘প্রিভূমি’ আমনোর কাছ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট বা আসন নিতে পারলে বিরোধী পক্ষ জয় পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বারিসান এবং পাস-এর আসন গতবারের তুলনায় কমে যেতে পারে অনেকটা। অন্য দিকে, চীনা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিএপি দলের প্রভাব আগের মতোই রয়ে গেছে। আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআরো এবার ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনায় বেশ উজ্জীবিত,
যদিও ভোট ক্যাম্পেইনে আনোয়ার এবার থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না। সার্বিকভাবে মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচন যতই কাছে আসছে, ততই অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দেশটির ‘রাজনৈতিক অভিনেতা’দের বক্তব্য-বিবৃতিতে মনে হচ্ছে, এবারের ফলাফল গতানুগতিকতার বাইরে চলে যাবে। এতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সোজা পথে না এগিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনে সিদ্ধান্তকারী কোনো ফল আসবে কি না, নাকি জরুরি অবস্থা জারি অথবা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হবে- এসব নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সাধারণ নির্বাচন এড়াতে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক জরুরি শাসন জারি করতে পারেন। দ্বিতীয় দৃশ্যপট সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, নির্বাচন হয়ে যাবে; কিন্তু ফলাফল এমন হবে যার ফলে একটি ঝুলন্ত সংসদ তৈরি হবে। অর্থাৎ কোনো দলই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা মাহাথির মোহাম্মদ জরুরি অবস্থা জারির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেলেন, প্রধানমন্ত্রী নাজিব সংসদ স্থগিত করতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছেন। অন্য কথায়, নাজিবের পিতা, দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৯ সালে বর্ণগত দাঙ্গার পরে বিরোধী দলের শক্তিশালী অবস্থা সৃষ্টির পর যা করেছিলেন, সেদিকে পুত্র নাজিবও যেতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিতে চাইছেন তিনি। মাহাথির মোহাম্মদ কুয়ালালামপুরে পাকাতান হারাপানের যুবকর্মীদের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে উল্লেখ করেন, নাজিব সংসদ স্থগিত করার যুক্তির ন্যায্যতা দেয়ার জন্য জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেন। এ জন্য তিনি পাকাতান কর্মীদের আগামী নির্বাচনে পপুলার ভোট এমন পর্যায়ে বাড়াতে বলেছেন; যাতে নাজিব জরুরি অবস্থা জারি করার সাহস করতে না পারেন। মালয়েশিয়ায় রাজার অনুমোদন ছাড়া প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে সক্ষম হবেন না। এ ছাড়া, তাকে এ জন্য ১৯৮০ সালে ফিলিপাইনের মতো, পুলিশবাহিনী ও সশস্ত্রবাহিনীর সমর্থনও পেতে হবে। তবে অনেকেই বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি) আইন ২০১৬ প্রধানমন্ত্রীকে এটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ এনে দিতে পারে। মাহাথির উল্লেখ করেছেন, নাজিব যদি জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেন, তাহলে আমরা এর অবসান এবং গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রতিদিনই রাস্তায় নামব।
আমনোর এককালের বিখ্যাত নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী টেংকু রেজালাহ হামজা ‘ঝুলন্ত’ সংসদের কথা বলছেন। আর এটা হলে উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে ঐকমত্যের সরকার হতে পারে বলে তিনি মনে করছেন। গত ২৭ জানুয়ারি রেজালাহ একটি পাবলিক ফোরামে পূর্বাভাস দেন, স্পষ্টভাবে কোনো বিজয়ী দল ছাড়াই আগামী নির্বাচন শেষ হতে পারে। ক্ষমতাসীন জোট বারিসান নাসিওনাল (বিএন) কিংবা বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান (পিএইচ) সরকার গঠন করতে যথেষ্ট সমর্থন পাবে না। এতে ঝুলন্ত সংসদ তৈরি হবে। এর মানে এই নয় যে, ভোটাররা সরকার পরিবর্তনের এবং বিকল্প জোটের পক্ষে নয়। বরং এর অর্থ, ভোটাররা একটি অবিভেদমূলক সরকার চান, যার মধ্যে সব রাজনৈতিক অংশীদার থাকবে। এর অর্থ হলো, একটি ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা যেখানে উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও ভালো রেকর্ডের একজন এমপি নেতা হতে পারেন। মাহাথির ২২ বছর ধরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও আমনোর নেতৃস্থানীয় একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। রেজালাহ নিজেও কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন; তিনি ১৯৮০-এর দশকে আমনোর নেতৃত্বের জন্য মাহাথিরকে চ্যালেঞ্জ করে সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। এখন উভয়েই প্রধানমন্ত্রী নাজিবের অধীনে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। জরুরি শাসন সম্পর্কে যাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের উদ্বেগও রয়েছে। মালয়েশিয়ার সেনাবাহিনীর একজন অভিজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জানান, নির্বাচনের আগে বা পরে যখনই হোক না কেন, সেনাবাহিনী তাদের নীতি হিসেবে, জাতীয় সঙ্কট নিয়ে আলোচনায় নিরপেক্ষ থাকতে হবে। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব প্যাট্রিয়টস সভাপতি মোহাম্মদ আরশাদ রাজি বলেন, ‘যখন সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং তারপর রাজনীতিবিদের কাছ থেকে নির্দেশ নেয়, তখন তা জাতির জন্য অকল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয়।’ পরিস্থিতি সরকারের একবারে প্রতিকূলে চলে গেলে প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে মনোযোগী হতে পারেন। তিনি একটি বৃহত্তর জোট তৈরির জন্য তার জোটকে পুনর্গঠিতও করতে পারেন। এমনকি তিনি পাস এবং চীনা সম্প্রদায় অধ্যুষিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টিকে (ডিএপি) আমন্ত্রণ জানাতে পারেন তার জোটে। পাস তাতে যোগ দিতে পারে এবং অস্বীকার করতে পারে ডিএপি। নাজিব ৪০ বছর আগে তার পিতার করা কাজকে অনুসরণ করে চীনের সাথে গড়তে পারেন বিশেষ সম্পর্ক। এভাবে তিনি ক্ষমতা রক্ষার চেষ্টা করতে পারেন। কারণ, দল হিসেবে আমনো এখনো ক্ষমতার বাইরে থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই চিন্তা করতে পারছে না। তবে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার কিভাবে হবে, কোন দল এতে উদ্যোগী হবে, কে এর নেতৃত্ব দেবেন- এ ধরনের নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। আর মালয়েশিয়ার রাজনীতি যে জটিল আবর্তে পড়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ কমই। অবশ্য নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং এর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হলে বিকল্প ভাবনাগুলো সাময়িকভাবে অন্তরালে চলে যেতে পারে।
mrkmmb@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.