প্রশ্নগুলো সামনে আনতে হবে by ডা. এম এ হাসান

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্বিচার যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা শুরু হয়, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল টার্গেট কিলিং, ধর্মভিত্তিক নিধন, জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক নির্মূল, বেছে বেছে প্রগতিশীল ব্যক্তি নিধন। ওই সময় ‘জোনোসাইডাল রেপ’, ‘এনফোর্সড মাইগ্রেশন’, পরিকল্পিত গুম ইত্যাদি অপরাধ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে যুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্যের বাইরে সাধারণের ওপর পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত আক্রমণ- নিবির্চার হত্যা তথা যুদ্ধাপরাধ এবং Crimes against humanity of murder. বেছে বেছে বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল গোষ্ঠীসহ বিশেষ মতাদর্শভিত্তিক একটি দল ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নেয়ার কারণে জেনোসাইড (Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide) আর্টিকেলের ২/ই ধারা অনুযায়ী, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে যে ব্যাপক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে হিন্দুগোষ্ঠীর ৬৯ লাখ (আগস্ট ’৭১-এর মধ্যে) মানুষকে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত (traumatized) করে নদ-নদী, বনাঞ্চল ও জলাশয়ের মধ্য দিয়ে দেশছাড়া করা হয়েছিল, তাতে ৫ থেকে ৬ লাখ হিন্দু নিশ্চিহ্ন হয় অথবা মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে। এতে ৪ লাখের মতো শিশুসহ মুসলিম জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন বা গুম হয়ে যায়। তারা আর কখনোই ফিরে আসেনি। তারা এমন এক কৃষ্ণবিবরে নিমজ্জিত হয়েছিল, যা থেকে কখনোই তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। পরিবারের কাছে তারা নিখোঁজ হয়ে আছে। এতে জেনোসাইড আর্টিকেলে ২/সি (Genocide by deliberately inflicting conditions of life calculated to bring about physical destruction) ধারা অনুয়ায়ী গণহত্যা প্রমাণিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় দেশের অভ্যন্তরে এবং অভিবাসনকালে কোনো কোনো ভিকটিমের শরীর ও মনে এমন ক্ষতিসাধন করা হয় যাকে আইনানুগভাবে গণহত্যা বলা যায়। হিন্দুকে যখন হিন্দু বলে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও গণহত্যা। কলেমা পাঠ করিয়ে ধর্মীয়সত্তা বিচার এবং খতনার চিহ্ন দেখে ধর্ম নির্ণয় এর প্রমাণ। এটি আরও প্রমাণিত হয় তাদের ধর্মীয় বিদ্বেষভিত্তিক ‘হেট মেসেজ’ এবং ব্যক্ত অভিপ্রায়ে। এ হেট মেসেজের মাধ্যমে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীসহ ভিন্ন মতাদর্শভিত্তিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার অভিলাষ ব্যক্ত হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের ভয়াবহ বিদ্বেষমূলক ও উসকানিমূলক বক্তব্যে। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় বিচারে শত্রু নিরূপণ করে গণহত্যার যে নষ্ট উদ্যোগ নেয় পাকিস্তানি সেনারা, তাতেই প্রমাণিত হয় তাদের কৃত অপরাধ। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ incitement ও complicity গণহত্যাকেই প্রমাণ করে। ঘাতকের নানা উক্তি ও ব্যক্ত অভিপ্রায় তথা নানা কর্ম তাদের পূর্বপরিকল্পনা এবং প্রকৃত অভিপ্রায়কে প্রমাণ করে। তাদের হত্যার ধরনগুলো এবং হত্যার পর তাদের মানসিক অবস্থান Dehumanization প্রক্রিয়াকে প্রমাণ করে। এ গণহত্যায় কাল, সময়, স্থান, নিহত মানুষের সংখ্যা, পরিচয়, দেহাবশেষের পরিচয়, যাবতীয় ফরেনসিক আলামত, artifect, ante-mortem evidence, postmortem, evidence সবকিছুই সামনে আনতে হবে গণহত্যা প্রমাণের জন্য। যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তা হল- গণহত্যা কে করেছে? কবে করেছে? কবে তা শুরু হয়েছে? কতদিন তা চলেছে? কোন ভুখণ্ডে তা হয়েছে? কী প্রক্রিয়ায় তা হয়েছে? নিহতদের সম্ভাব্য পরিচয় কী? তাদের জাতিগত, ধর্মগত, গোষ্ঠীগত পরিচয় কী? তাদের লিঙ্গভিত্তিক অবস্থান কী? ইত্যাদি। ঘাতকের মুখ্য ইচ্ছা, পরিকল্পনা, প্রধান পরিকল্পকদের পরিচয়; পরিকল্পনায় ব্যবহৃত শক্তি, পরিকল্পকদের পেছনের প্রচ্ছায়া বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নানা ধাপ, পদক্ষেপ, নানা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের অন্তর্ভুক্তিকরণ যথাসম্ভব স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন লক্ষ্য ও আক্রমণের শ্রেণীবিন্যাস। এ আলোকেই ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি এগিয়ে নিতে হবে। তবে বাস্তবতার আলোকে ওই দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের আগে ’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে এমন স্বীকৃতি আদায় করা প্রয়োজন। ওই বিষয়টি বা ’৭১-এর গণহত্যার ঘটনাক্রম প্রমাণ করতে হবে গণহত্যার সংজ্ঞার আলোকে। জেনেভা কনভেনশন ও জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা বলতে সমষ্টির বিনাশ ও অভিপ্রায়কে বোঝায়। এ গণহত্যা বলতে বোঝায় এমন কর্মকাণ্ড, যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন ২৬০(৩)-এর অধীনে গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সব রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। সংজ্ঞা অনুযায়ী, গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে জাতিগত, গোষ্ঠীগত বা ধর্মগত নিধনের উদ্দেশ্যে যদি একজন লোককেও হত্যা করা হয়, সেটাও গণহত্যা। যদি কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্ম রুদ্ধ করার প্রয়াস নেয়া হয় বা পরিকল্পিতভাবে বিশেষ জাতি ও গোষ্ঠীভুক্ত নারীর গর্ভে একটি ভিন্ন জাতির জন্ম দেয়ার চেষ্টা করা হয়, সেটাও গণহত্যা। তবে শেষের বিষয়টিকে ‘জেনোসাইডাল রেপ’ বলা হয়। কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থ বা রাজনৈতিক অভিসন্ধি নয়, বাঙালির প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ২৫ মার্চ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা ও ক্রোধের বিষয়টি Prime perpetrator বিশ্বাসের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। তাদের শীর্ষ ক্রোধ ছিল বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মী এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ওপর। গণহত্যায় বিনাশকৃত মানুষের শ্রেণীবিন্যাসের সঙ্গে বধ্যভূমির সংখ্যা, তার বিন্যাস ও জেনোসাইডাল ম্যাপটি উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সৌভাগ্যক্রমে এমন একটি জিপিএস ম্যাপ রয়েছে WCFFC- এর হাতে। ৫ হাজার বধ্যভূমিতে প্রায় ৯১১টি বধ্যভূমির তালিকাও রয়েছে। রয়েছে ৮৮টি নদী এবং ৬৫টি ব্রিজের তালিকা, যেখানে নিয়মিত হত্যা করা হল নিরস্ত্র মানুষদের। বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিহতদের একটি তালিকাও রয়েছে। এ সংক্রান্ত বিবরণসহ অপরাধের কেস হিস্ট্রি বিবৃত হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা বিচারের অন্বেষণ’ শীর্ষক একটি গ্রন্থে এবং ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘Beyond Denial’ গ্রন্থে। সম্ভবত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেষ গ্রন্থটি ব্যবহার করছে। এতে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিহতদের একটি তালিকাও রয়েছে। ভিকটিমের বয়ান এবং অপরাধীর বিবরণসহ ওইসব গ্রন্থে রয়েছে শর্মিলা বোসের মিথ্যাচারের উত্তর। এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সুবিন্যস্ত কেস রিপোর্ট তৈরি করতে হবে এবং তা নিয়ে দেশে দেশে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। এ সংক্রান্ত স্বীকৃতির জন্য ওইসব দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিসহ তাদের অতিথিদের দেখাতে হবে দেশের বিভিন্ন ক্ল্যাসিকাল গণহত্যা ভূমি এবং গণহত্যার আলামত। সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয় সুদূরপরাহত বা প্রায় অসম্ভব বলে বিবেচিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই দাবি থেকে সরে এসে ওই দিবসকে International Day of Resistance against War and cruelty হিসেবে ঘোষণা দেয়ার দাবি জানাতে হবে। এটাই আমাদের গণহত্যাকে সামনে আনবে। ২০০৪-এ প্রতিকূল পরিবেশ ও সময়ে WCFFC- যখন ইউনেস্কোর কাছে এমন দাবি জানায়, তখন ওই সংগঠনের এডিজি মি. পিয়ারে সেন WCFFC-কে লেখেন-‘I acknowledge with thanks receipt of your email to UNESCO by which you request support to mark 25 March as the International Day of Resistance against War and cruelty. ... proposals (...) should be submitted [by †overnments of Member States or by NGOs] directly to the Assembly.’ এখন রাষ্ট্রকে ওই দাবিটি সামনে আনতে হবে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটি ধরার জন্য, উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য। বিরুদ্ধ স্রোত ও অতিক্রান্ত সময় বিবেচনা করে রাষ্ট্রকে কিছু সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে দেশের মধ্যে এবং দেশের বাইরে। এটি করতে হবে কৃষ্ণরাতকে সামনে আনার জন্য- Price of Freedom-কে সমুন্নত করার জন্য। চূড়ান্ত বিচারে ২৫ মার্চের আঘাতটি ছিল মানুষের জীবনের ন্যায্য অধিকারের প্রতি, মানবমর্যাদার প্রতি, স্বাধীন সত্তাসংশ্লিষ্ট চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার প্রতি। দেশে দেশে ঘটে যাওয়া সভ্যতাবিনাশী, মর্যাদাবিধ্বংসী এমন নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্যই ২৫ মার্চের মতো দিনগুলোকে স্মরণীয় করে রাখা প্রয়োজন। এটি স্মরণ করতে হবে এ কারণে যাতে এমন দিন আর কোথাও ফিরে না আসে। ২৫ মার্চের কৃষ্ণরাতে জমাট হয় যে আকাঙ্ক্ষা, তা স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এটাকে সামনে এনে আলোকোজ্জ্বল করতে হবে জাতির আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ।
ডা. এম এ হাসান : মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ক গবেষক
dhasan471@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.