বেকারত্ব বনাম অবসরসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব by মনজু আরা বেগম

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসর নেয়ার বয়স তিন বছর বাড়িয়ে দিতে আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যার অনুলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়। সরকারি চাকরিতে যারা আছেন তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি সুখবর ও ভালো প্রস্তাব কিন্তু যেসব অভিভাবক খেয়ে না-খেয়ে কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে ভবিষ্যতে একটা ভালো চাকরির আশায়, সুন্দর স্বপ্ন লালন করেছে সুন্দর একটা জীবনের জন্য; কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে একটা বিরাট ধাক্কা খেয়ে প্রতিনিয়ত বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তাদের কথা কি তিনি একবারও চিন্তা করেছেন? নিশ্চয় করেননি। করলে হয়তো তিনি এক লাফে অবসরের সময়সীমা তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব কখনোই করতেন না। দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩১ হাজার বলা হলেও প্রকৃত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকার ১৪.২ ভাগ। এ হিসাবে ২ কোটি ২ লাখ বেকার রয়েছে দেশে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি। বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার ৯ ভাগ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। বেকারত্বের কারণে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। এবারে ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩২ জন। ৩৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে অংশগ্রহণ করেছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৬ জন। জানা যায়, ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে চূড়ান্তভাবে ৫ হাজার ২৩১ জন উত্তীর্ণ হলেও বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে ২ হাজার ৩২৩ জনকে। অর্থাৎ বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও চাকরির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে আরও ৩ হাজার ৩০৮ জন তরুণ-তরুণী। ২০ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে জাতীয় সংসদে জনপ্রশাসন মন্ত্রীর বক্তব্যে জানা যায়, দেশে সরকারি অফিস, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, আধা সরকারি সংস্থা, অধিদফতরগুলোয় শূন্যপদ রয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি।
এ বিরাটসংখ্যক শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিনের পর দিন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ক্ষমতাবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে এসব মেধাবী তরুণ-তরুণী। এসব খবর কি আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের নজরে আসছে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এতগুলো শূন্যপদ দ্রুত পূরণের উদ্যোগ না নিয়ে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে অবসরের সময়সীমা বাড়াতে তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন কোন যুক্তিতে? চাকরিতে প্রবেশ করলেই একসময় অবসরে যেতে হবে এটি অনিবার্য। উপরের দিকে অবসরজনিত অথবা মৃত্যুজনিত কারণে পদ শূন্য হলে সেসব উচ্চতর পদে পদোন্নতি দিয়ে নিচের দিকে নিয়োগের মাধ্যমে পদ পূরণ করা জরুরি। এটি যথাসময়ে না হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যেমন হতাশা বিরাজ করে তেমনি দাফতরিক কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে কী সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি হয় তা ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের প্রশাসন সেভাবে চলছে না। অবসরজনিত শূন্যপদে যথাসময়ে নিয়োগ না দেয়ায় চাকরির ধারাবাহিকতায় বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে চাকরির অবসরসীমা বৃদ্ধির প্রয়োজন অবশ্যই আছে। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয়ও অবসরে যাওয়ার সময়সীমা আমাদের চেয়ে বেশি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে আমাদের সব দিক বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে কিন্তু যেভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে সেভাবে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় কর্মসংস্থানও তেমনভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না। আমাদের দারিদ্র্যের হার এখন সাড়ে তেইশ শতাংশ। প্রায় ২ কোটি মানুষ অতি দরিদ্র। শুধু সরকারি চাকরির ওপর নির্ভর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। জুলাই ২০১৭ তে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতিসংঘের পর্যালোচনা সভায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়ন প্রতিবেদন পেশ করা হয়। এতে আশা প্রকাশ করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে একটি হবে বাংলাদেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত হওয়ার পাশাপাশি একটি মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হবে বাংলাদেশ, এমনটাই মনে করে সরকার। বাংলাদেশ গত চার দশকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করলেও কর্মসংস্থানের দিক থেকে পিছিয়ে আছে। বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের দেশজ উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি বছরে গড়ে ৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে এবং বিগত দুই বছরে ৭ শতাংশে উন্নীত হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, বাংলাদেশে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৫ লাখ। বিবিএসের মতে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২০ লাখ। সম্প্রতি বিবিএসের শ্রম শক্তির জরিপে জানা যায় দেশে ৭১ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি কাজ করেন না, ২৬ লাখ লোক বেকার এবং সাড়ে সতেরো লাখ খণ্ডকালীন কর্মজীবী এবং এখনই চাকরি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ২৭ লাখ। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়লেও দারিদ্র্যও বেড়েছে, যদিও সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য কমেছে; কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্য। ১০ শতাংশ ধনীর হাতে রয়েছে ৩৮ শতাংশ আয়। এবং গরিব ১০ শতাংশ মানুষ আয় করেন মোট আয়ের ১ শতাংশ। বিগত ছয় বছরে সার্বিক দারিদ্র্যের হার সাড়ে ৩১ শতাংশ থেকে কমে ২৪.৩ শতাংশে এসেছে। দেশে সার্বিকভাবে সবার আয় বাড়লেও ধনিক শ্রেণীর আয় তুলনামূলকভাবে বেশি বেড়েছে। বিবিএসের ২০১৬ সালের খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ থেকে এ তথ্য জানা যায়। দেশে অতি দরিদ্রের হারও কমেছে। ২০১৬ সালে অতি দরিদ্রের হার ছিল ১২.৯ শতাংশ যা বিশ্বের গড় দরিদ্রের হারের চেয়ে কম। বিশ্বের গড় দরিদ্রের হার ১৩.৮ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৯৩ লাখ এবং অতি দরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ। দেশে এখনই চাকরি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ২৭ লাখ। কাজেই এ পরিস্থিতিতে অবসরের সময়সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন না করে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সীমিত সংখ্যক দক্ষ এবং অভিজ্ঞ মেধাসম্পন্ন সৎ কর্মকর্তা/কমচারী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানের বিষয়টি অব্যাহত রাখলে সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হবে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক
monjuara2006@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.