সিসাকে মাদকের আওতায় আনার প্রস্তাব by শুভ্র দেব

অত্যাধুনিক সাজসজ্জা। আবছা অন্ধকার। উচ্চ শব্দে বাজছে হিন্দি-ইংরেজি গান। টেবিলে টেবিলে সাজানো সিসা সেবন করার হুক্কা। সিসায় টান দিয়ে হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচিতে মেতে উঠছে তরুণ-তরুণীরা। শুধু তরুণ-তরুণী নন এখানে সব বয়সীদের বিচরণ।
এ যেন অন্যরকম এক উন্মাদনা। বনানীর ১১ নম্বর সড়কের জেনেটিক পয়েন্ট এগারোর ১২ তলার ফাহরেনহাইট সিসাবারের চিত্র এমনটাই। ফাহরেনহাইটের সহকারী ব্যবস্থাপক রফিক বলেন, আমরা এখন আর কোনো পার্টি থ্রো করি না। তবে কেউ যদি পার্টি করতে চায় সেক্ষেত্রে আমরা আয়োজন করি। তবে আমাদের এই রেস্টুরেন্টটি মূলত সিসাবার। সঙ্গে খাবারের আইটেম রয়েছে। এখানে ক্ল্যাসিক সিসার সঙ্গে রেগুলার কফিসহ ১ হাজার টাকা ও প্রিমিয়াম সিসার সঙ্গে দুটি হট চকোলেটসহ ১ হাজার ৬০০ টাকা। ফাহরেনহাইটের ঠিক উল্টোপাশে গ্রিন ডিলাক্স ভবনের ৬ তলার গিটার স্টিংগস সিসা বারের অবস্থাও প্রায় একই। সামনে ফুড আইটেম। ভেতরে সীসা লাউঞ্জ। বিক্রয় সহকারী প্রদীপ বলেন, আমরা সিসা সেবনের জন্য ১ হাজার টাকা নেই। এর বাইরে খাবারের জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়। তবে মিন্ট, গ্রেইভ, ডাবল আপেল, কিউইউ, অরেঞ্জসহ আরো কিছু ফলের নির্যাসের আদলে সিসা সেবন করার সুবিধা রয়েছে। সরজমিন বিভিন্ন সিসাবার ঘুরে ও সিসাসেবীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায় এখানে অধিকাংশ সিসাসেবীরাই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তারা বন্ধুদের হাত ধরে সিসায় ঝুঁকছেন।
মোগল আমল থেকে সিসার প্রচলন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সিসা এখনো অনেক জনপ্রিয়। বিভিন্ন ফলের নির্যাস দিয়ে তৈরি হয় সিসার উপাদান। কিন্তু অভিযোগ আছে বাংলাদেশে সিসার আড়ালে মেশানো হচ্ছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)-এর পরীক্ষায় মাদক মেশানোর বিষয়টি ধরা পড়েছে। এমনকি ল্যাবে পরীক্ষা করে সিসায় মাদক মেশানোর আলামত পাওয়া গেছে। এছাড়া গোয়েন্দা তথ্যও বার বার সিসায় মাদকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিসা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর মধ্যে উচ্চমাত্রার টক্সি, কার্বন মনো-অক্সাইড হেভি মেটালসহ ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে। টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল হাসিসের নির্যাসের সঙ্গে রাসায়নিক মিশ্রণে সিসা তৈরি হয়। এতে নিকোটিনের পরিমাণও থাকে মাত্রাতিরিক্ত। তামাক বিশেষজ্ঞদের মতে, এক সেশনে সিসা টানলে ৫৪টি সিগারেটের সমান ক্ষতি হয়। এছাড়া সিসার ধোঁয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোঅক্সাইড থাকে, যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাদের মতে সিসা সিগারেটের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এছাড়া সিসায় ফলের নির্যাসের সঙ্গে অন্যান্য ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। অন্য মাদকে যে ক্যানসার ছড়াতে পাঁচ বছর সময় লাগবে সেখানে নিয়মিত সিসায় আসক্ত হলে দুই বছরের মধ্যে শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, তাদের কাছে কাগজে কলমে এখন ১০৮টি সিসা লাউঞ্জ বা সিসা বারের তালিকা আছে। তবে প্রকৃতপক্ষে সিসা বারের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত ৩ শতাধিক রেস্তরাঁয় এ ব্যবসা চালানো হচ্ছে। আর সিসাসেবী এখন ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। রাজধানীর সিসা লাউঞ্জ ও বারগুলোর মধ্যে অন্যতম গুলশানের ক্লাব অ্যারাবিয়ান, জাবেদ কাড লাউঞ্জ, হাবুল-কাবুল, মাউন্ট আল্টা লাউঞ্জ, জোন জিরো লাউঞ্জ, এক্সিট লাউঞ্জ। বনানীর ফাহরেনহাইট, ফিউসন হান্ট, ডকসিন, কফি হাউজ, মিলাউন্স, বেইজিং লাউঞ্জ, মিট লাউঞ্জ, সিক্সথ ফ্লোর, মোহাম্মদপুরের অ্যারাবিয়ান নাইটস, ফুড কিং, ধানমন্ডির সেভেন টুয়েলভ লাউঞ্জ, ডমিনেন্স পিজা, কিউ কিউ টি অ্যান্ড লাউঞ্জ, এইচ টু ও লাউঞ্জ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, ঝাল লাউঞ্জ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বেইলি রোডের থার্টি থ্রি ও খিলক্ষেতের হোটেল রিজেন্সি।
সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশন থেকে হোটেল ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে আড়ালে চালায় সিসা বার। অনিয়ন্ত্রিতভাবে
চলায় বিভিন্ন সময় সিসা বারে ডিএনসি কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু সিসা বারে অভিযানের জন্য রেস্তরাঁ মালিকরা হাইকোর্টে রিট করেছে। রেস্তরাঁ মালিকদের অভিযোগ তারা সিসাতে কোনো মাদকদ্রব্য মেশান না। অযথাই ডিএনসি কর্মকর্তারা তাদের হয়রানি করেন। আবার ডিএনসি কর্মকর্তারা বলছেন, রেস্তরাঁ মালিকরা গোপনে সিসাতে মাদকদ্রব্য মিশিয়ে দেন। যদি সিসাতে মাদক মেশানো হয় তবে সেটি অবৈধ। তবে সিসাকে মাদকের আওতায় আনার জন্য আইনের খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিসা বারের জন্য ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তদন্ত কমিটি সিসা বারের জন্য বেশকিছু সুপারিশও করে। যারমধ্যে সিসাকে মাদকের আওতায় আনার কথা বলা হয়। এছাড়া সিসা বারের জন্য লাইসেন্স নেয়ার নিয়ম ও ২৫ বছরের কম বয়সীদের সিসা বারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও বিদেশিদের জন্য পাঁচ তারকা হোটেলে ব্যবস্থা গ্রহণ ও বর্তমানে চালু সিসা বারগুলো বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়। যদিও কার্যত তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ইদানীং সীসা বারের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ বেশ তৎপর। সমপ্রতি ডিএনসি মাদকদ্রব্য আইনে সিসাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইনের খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া, গত ১০ই ডিসেম্বর সিসা বারগুলোতে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে কী বিক্রি হচ্ছে তা দেখার জন্য অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং ভ্যাট (ভ্যালু এডেড ট্যাক্স) বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) গোয়েন্দা দপ্তরে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রধানত ডিএনসির সহযোগিতা নিয়ে সিসার রেস্তরাঁগুলোতে অভিযান চালাতে হবে।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার মানবজমিনকে বলেন, বিভিন্ন সময় আমরা সিসাবারে অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু রেস্তরাঁ মালিকদের হাইকোর্টে রিটের কারণে আপাতত সেটি স্থগিত আছে। তাদের দাবি সিসাতে মাদকের কোনো মিশ্রণ নাই। তবে অভিযোগ আছে সিসাতে মাদক মেশানো হয়। ল্যাব টেস্টেও অনেক সময় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাই সিসাকে মাদকের আওতায় আনার জন্য আমরা প্রস্তাবনা করেছি। তিনি বলেন, বার আর সিসা লাউঞ্জ মিলিয়ে আমাদের কাছে ১০৮টির মতো তালিকা আছে। এর বাইরে আমাদের অজানা অনেক সিসা বার থাকতে পারে। মাদকের আওতায় আনা গেলে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

No comments

Powered by Blogger.