ভোটের হাওয়া রাজধানীতে

তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজধানী ঢাকায় বইছে ভোটের হাওয়া। ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে উপনির্বাচনের পাশাপাশি দুই সিটিরই বর্ধিত ৩৬ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ফলে রাজধানীজুড়েই এখন চলছে নির্বাচনী আমেজ। এমনকি নির্বাচনী আচরণবিধিতে প্রচারণা নিষিদ্ধ থাকলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা আগাম প্রচার ও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। উত্তর সিটিতে আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রত্যাশী হিসেবে এরই মধ্যে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন ডজনখানেক প্রার্থী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি মাঠে নেমেছেন একাধিক বাম সংগঠনের নেতারাও। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রধান প্রধান সড়ক ও পাড়া-মহল্লায় ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন টাঙিয়ে নিজেদের প্রচার চালাচ্ছেন। সামাজিক নানা উপলক্ষ ও আয়োজনে অংশ নিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ ভোটারের এ সিটিতে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। শোনাচ্ছেন প্রতিশ্রুতি, জানাচ্ছেন আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার অঙ্গীকার। দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীরা ভোটারদের পাশাপাশি সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও নিজের পক্ষে টানতে চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।
দলের সমর্থন পেতে কেন্দ্রীয় নেতাদের আনুকূল্য পাওয়ার দৌড়ও চলছে সমানতালে। প্রার্থীদের ব্যস্ততায় ভোটারেরাও ভোট নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন আগেভাগেই। বিভিন্ন দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারেরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। তাই মনোনয়নের জন্য দলগুলোকে খুব ভেবেচিন্তে প্রার্থী বাছাই করতে হচ্ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পরপরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু করেছে দলগুলো। বিএনপির মেয়রপ্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত হলেও তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার অপেক্ষায়। আওয়ামী লীগ থেকে একজনকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয়ার কথা বলা হলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে ১৬ জানুয়ারি দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে। এ ছাড়া প্রার্থী ঘোষণা করছে সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট ও এনডিএম। তবে যোগ্য প্রার্থী না থাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির কেন্দ্রীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তফসিল ঘোষণার পরের দিন দলের আগ্রহীদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলীয় সভাপতির ধানমন্ডি অফিস থেকে শনিবার মনোনয়নের আবেদন ফরম বিতরণ শুরু হয়েছে। এটি সংগ্রহ ও জমাদান চলবে আজ সোমবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেত পেয়েছিÑ এমন দাবি করে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গণসংযোগ করছেন বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম। দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণের প্রথম দিনে শনিবার বিকেলে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসে দলের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবাহান গোলাপের কাছ থেকে আতিকুল ইসলামের পক্ষে তার প্রতিনিধিরা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।
প্রতিনিধিদলে ছিলেন তার নির্বাচনী সমন্বয়ক এ কে এম মিজানুর রহমান ও সহকারী সমন্বয়ক ইমতিয়াজ মঈনুল ইসলাম। এর আগে সকালে ফরম সংগ্রহ করেন দুই মেয়র প্রার্থী রাসেল আশেকী ও আদম তমিজি হক। এ দিন আরো মনোনয়নপত্র কিনেছেন প্রিন্সিপাল শাহ আলম ও মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন। প্রার্থীরা সমানতালে বিভিন্ন জায়গায় গণসংযোগ ও নেতাকর্মীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যোগাযোগ রাখছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথেও। হক গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আদম তমিজি হক বলছেন, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তাকেও প্রচারণা চালাতে বলেছেন। আদম তমিজি হক ও আতিকুল ইসলাম দু’জনই ইতোমধ্যে নগরবাসীকে আধুনিক ঢাকা উপহার দিতে যেসব কাজ করা প্রয়োজন সেভাবে রোডম্যাপ তৈরি করেছেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি অভিনেত্রী কবরী সারোয়ারসহ কয়েকজন নৌকার মনোনয়ন নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন করতে চান। এ দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একজনকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয়ার কথা বলা হলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে আগামীকাল। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা ডাকা হয়েছে। সভার আগে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেবে মনোনয়ন বোর্ড। আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ওই সভাতেই দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে থেকে চূড়ান্ত করা হবে নৌকার প্রার্থী। ভোটকে সামনে রেখে শনিবার প্রার্থী ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে দলের পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগ্রহী প্রার্থীদের পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এ মনোনয়নপত্র ফরম কিনতে হবে। আজ সোমবারের মধ্যে দলের তহবিলে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে এই ফরম জমা দিতে হবে। এবং রাত সাড়ে ৮টা থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। বিএনপির এ ঘোষণার পর রোববার সকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচনে বিএনপির হয়ে মনোনয়ন পাওয়ার আশায় ফরম কিনেছেন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আসা বিএনপির সহপ্রকাশনা সম্পাদক শাকিল ওয়াহেদ, তাবিথ আউয়াল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপন, সাবেক সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর আখতারুজ্জামান এবং ঢাকা উত্তর বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ুম। মনোনয়নের দৌড়ে তাবিথ আউয়াল এক নম্বরে থাকলেও তাকে নিয়ে দলে কিছুটা সমালোচনাও আছে। বিগত নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্ক ভালোভাবে রক্ষা না করা এবং জনগণের পাশে তার না দাঁড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। কোনো কোনো নেতার মত হচ্ছে- বিগত নির্বাচনে তাবিথ আউয়াল বিএনপির মূল প্রার্থী ছিলেন না, দলের প্রার্থী ছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি নির্বাচনে অযোগ্য না হলে তাবিথ আউয়ালের আসার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এবার যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন সেহেতু বিএনপির অনেক যোগ্য নেতার মধ্য থেকে প্রার্থী বাছাই করে সবচেয়ে যোগ্য নেতাকে প্রার্থী করা উচিত হবে। আরেক প্রার্থী শাকিল ওয়াহেদ নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। ঢাকায় লাগানো হয়েছে তার পোস্টার। ফেসবুকে প্রচারণা চলছে। নির্বাচন কমিশন থেকে নিয়েছেন মনোনয়নপত্র। গতকাল আগারগাঁও নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে স্থাপিত ঢাকা উত্তর সিটির রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে তিনি মনোনয়নপত্র নেন। শাকিল ওয়াহেদ বলেন, সকালে প্রথম দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে দলের মনোনয়নপত্র নিয়েছি। সম্ভবত আমিই প্রথম দলের মনোয়ন নিয়েছি। এরপর এখানে এসেছি।
দলের মনোনয়নের বিষয়ে আমি আশাবাদী। অবশ্য দল আমাকে মনোনয়ন না দিলেও দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করব। এ দিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি সেলিম উদ্দিনকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিবরিয়া বলেন, উত্তর সিটির ভোটার তালিকা কিনেছি আমরা। পরে ব্যাংক চালানটি দেখিয়ে মনোনয়নপত্র নেয়া হবে। জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, উত্তর সিটিতে মেয়র পদে নির্বাচন করতে চায় দলটি। ইতোমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা ১৫ জামায়াতকে ছেড়ে দিলে সিটি নির্বাচন থেকে সরে আসবে দলটি, এমন শর্তে ২০ দলীয় জোটে আলাপ-আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেও সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। তারা যোগ্য মেয়রপ্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা। এ ক্ষেত্রে দলীয় চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে এ নির্বাচনের বিষয়ে কোনো গ্রিন সিগন্যাল পাননি কোনো নেতাই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন উপনির্বাচনে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হচ্ছেন ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ। ২০১৫ সালেও এ সিটি নির্বাচনে তিনি দলের পক্ষে প্রার্থী হয়ে প্রায় ১৮ হাজার ভোট পান। সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতনকে মনোনয়ন দিচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন ২০১৫ সালেও ডিএনসিসি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ওই বছর তিনি হাতি মার্কা নিয়ে দুই হাজার ৪৭৫টি ভোট পেয়েছিলেন। এ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ১৮ জানুয়ারি। মনোনয়নপত্র বাছাই ২১ ও ২২ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৯ জানুয়ারি। আর ভোট হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি করে ৩৬টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং ছয়টি করে ১২টি সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন হবে। ডিএনসিসিতে বর্তমান ভোটার সংখ্যা ২৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫১০। এই সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত ১৮টি ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ২৩১টি, ভোটকক্ষ এক হাজার ২৩১টি, অস্থায়ী ভোটকক্ষের সংখ্যা ৫৬। মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ৭৭ হাজার ৫১০ জন।

No comments

Powered by Blogger.