নির্বাচনে জেতার আশা করেননি ট্রাম্প by মাইকেল উলফ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে লেখা বই ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি : ইনসাইড দ্য ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ প্রকাশের পরই তোলপাড় শুরু হয়েছে মার্কিন মুল্লুকে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক মাইকেল উলফের বইটির প্রকাশনা ঠেকাতে আইনি পদক্ষেপও নিয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে তাতে কাজ হয়নি। বরং নির্ধারিত তারিখের আগেই গত ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে বইটি। প্রকাশের প্রথম দিনেই শেষ হয়ে যায় সব কপি। অগ্রিম অর্ডার দেয়া হয় দশ লাখ কপির। বইটির চুম্বক অংশ নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। ভাষান্তর করেছেন আহমেদ বায়েজীদ
[পর্ব-১]
৮ নভেম্বর, ২০১৬, বিকেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা দলের ম্যানেজার কেলিয়ানি কনওয়ে ট্রাম্প টাওয়ারে তার অফিসে বসে আছেন। কনওয়ে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান চরিত্র, ট্রাম্প ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত না হলে সেটি হবে তার চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা- এই ভাবনায় প্রফুল্ল ছিলেন কনওয়ে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, ট্রাম্প নির্বাচনে হারতে চলেছেন এবং খুব সম্ভবত ব্যবধান হবে ছয় পয়েন্টের বেশি। তবে (ট্রাম্পের) ওই বিজয় ছিল দারুণ এক বিজয়। ট্রাম্প পরাজিত হলে তিনি ভোল পাল্টাতেন : বলতেন- তার নয়, রেন্স প্রিবাসের দোষে হেরেছেন ট্রাম্প। সারা দিন রাজনৈতিক অঙ্গনের বন্ধু ও পরিচিত জনদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন প্রিবাসের ঘাড়ে দোষ দিয়ে। যেসব টিভি প্রযোজক ও সাংবাদিকদের সাথে সম্পর্ক আছে, তাদেরও জানালেন বিষয়টি। গত কয়েক সপ্তাহে এই সাংবাদিকদের তিনি বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন; আশায় ছিলেন নির্বাচনের পর কোনো টিভি চ্যানেলে স্থায়ী চাকরিও পাবেন। আগস্টের মাঝামাঝি ট্রাম্পের প্রচারণা দলে যোগ দিয়েছিলেন কনওয়ে। জোরালো বক্তব্য আর সুন্দর ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলতেন, নির্বাচনী প্রচারণার অন্যান্য ভয়াবহ সমস্যা সত্ত্বেও যে দুষ্টচক্র ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তা হলো- রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির প্রধান রেন্স প্রিবাস, তার সহকর্মী ৩২ বছর বয়সী কেটি ওয়ালশ ও তাদের আরেক সঙ্গী শন স্পাইসার।
গত গ্রীষ্মে ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন লাভের পর থেকেই রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। মূলত এটিই তাদের প্রধান হাতিয়ার। যখন ট্রাম্পকে এগিয়ে দিতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, তারা তা নেয়নি। এটি ছিল কনওয়ের আক্রমণের প্রথম অংশ। অন্য অংশটি ছিল, শত সমস্যা সত্ত্বেও প্রায় তলিয়ে যাওয়া একটি প্রচারণা দল আবার উঠে দাঁড়ায়। তাদের টিমের কার্যক্রম চালানোর মতো লোকবল ছিল চরম অদক্ষ- আর ছিলেন আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে প্রার্থী। কখনো ট্রাম্পের নাম উচ্চারিত হলেই কনওয়ের ভ্রু কুঁচকে যেত। তবে তিনি প্রকৃতপক্ষেই দারুণ কাজ করেছিলেন। এর মধ্যে ট্রাম্প ক্যাম্পেইন টিমের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষক জন ম্যাকলাফলিন এক সপ্তাহ বা তারও কিছু আগে থেকে বলতে শুরু করলেন যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্টেটের সদস্যরা ট্রাম্পের সুবিধাজনক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। তবে কনওয়ে, ট্রাম্প নিজে এবং তার জামাতা জ্যারেড কুশনার- যিনি ছিলেন প্রচারণার কার্যত প্রধান- এরা প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে, তাদের এ অপ্রত্যাশিত দুঃসাহসিক যাত্রা শিগগিরই শেষ হচ্ছে। একমাত্র স্টিভ ব্যানন তার অভিজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে জোর দিয়ে বলতেন যে, ফলাফল তাদের পক্ষে আসবে। কিন্তু ব্যাননের এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীত। ট্রাম্পের ছোট্ট সেই প্রচারণা দলটির প্রত্যেকেরই ছিল স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। দলের সবাই তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে বাস্তববাদী ছিলেন। সবার ভাবনার মধ্যেই একটি বিষয়ে মিল ছিল, যদিও কেউ কাউকে বলতেন না সেটি- ট্রাম্প শুধু প্রেসিডেন্ট হবেন না তাই নয়; তার সম্ভবত প্রেসিডেন্ট হওয়াই উচিতও নয়। নির্বাচনী প্রচারণা যখন শেষ দিকে চলে আসে, ট্রাম্প নিজে আশাবাদী হয়ে উঠতে থাকেন। ভয়াবহ বিলি বুশ টেপ যখন ফাঁস হয়েছে, তিনি তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। তবে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দিয়েছিল।
এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে ই-মেইলে কেলেঙ্কারির ঘটনা পুনঃতদন্তের ঘোষণা দিয়ে হিলারির নির্বাচন এক প্রকার ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। হিলারির যে বিশাল বিজয়ের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল, তা এর মাধ্যমে তিনি পাল্টে দেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প একবার তার বন্ধু স্যাম নুনবার্গকে বলেছিলেন, ‘আমিই হতে পারি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ।’ নুনবার্গ প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু আপনি কি প্রেসিডেন্ট হতে চান? (একজন প্রার্থীকে যাচাই করার জন্য এটি কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটি হওয়া উচিত ছিল ‘কেন আপনি প্রেসিডেন্ট হতে চান’?) যা হোক, নুনবার্গ সে প্রশ্নের উত্তর পাননি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ারও দরকার ছিল না ট্রাম্পের, কারণ তিনি তো আর ‘প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন না’। ট্রাম্পের দীর্ঘ দিনের বন্ধু রজার আইলেস প্রায়ই বলতেন, তুমি যদি টেলিভিশনে ক্যারিয়ার গড়তে চাও, আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াও। রজারের কথায় উৎসাহিত ট্রাম্প তার টেলিভিশন নেটওয়ার্কের বিষয়ে বিভিন্ন কথা ছড়াতে থাকেন। এটির একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। ট্রাম্প রজারকে নিশ্চয়তা দিতেন যে, এই নির্বাচনী প্রচারণা থেকে তিনি অনেক বেশি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও অনেক সুযোগ নিয়ে বের হবেন। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এক আলাপে তিনি রজারকে বলেছেন, ‘আমি সব সময় যা স্বপ্ন দেখেছি, এটি তার চেয়েও বেশি। আমি পরাজয় নিয়ে ভাবছি না, কারণ এটি (নির্বাচনে হারা মানেই) পরাজয় নয়। সব কিছুতেই আমাদের জিত হয়েছে’। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি কী বক্তব্য দেবেন, সেটিও ভেবে রেখেছিলেন। বলতেন, ‘ফলাফল চুরি করা হয়েছে!’ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ক্ষুদ্র প্রচারণা দল পরাজয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা জেতার জন্য তৈরি ছিল না। রাজনীতিতে কেউ জিতবে, কেউ হারবে; কিন্তু একটি বিষয় অপরিবর্তনীয় যে, সবাই বিজয়ের চিন্তা করবে এবং আপনি সম্ভবত জিততেও পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি বিশ্বাস করবেন যে, আপনি জিততে চলেছেন।
তবে একমাত্র ট্রাম্পের প্রচারণা দল ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের মধ্যে সম্মিলিতভাবে একটি সুর ধ্বনিত হতো যে, তাদের প্রচারণা ছিল কতটা নি¤œমানের এবং এখানে যারা জড়িত আছে তারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে ট্রাম্প মনে করতেন যে, হিলারির লোকগুলো অত্যন্ত মেধাবী। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তারা সেরা লোকগুলো পেয়েছে, আমরা পেয়েছি সবচেয়ে বাজেগুলো’। ট্রাম্পের প্রচারণার সময় তার সাথে বিমানে কাটানো সময়গুলো থেকে একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে (লেখকের) যে, তার চারপাশে যারা আছে সবাই আহাম্মক। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণার শুরুর দিকে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কোরি লেওয়ানডোস্কি। প্রার্থী নিজেই তাকে মাঝে মধ্যে অপমান করতেন। কয়েক মাস ধরে ট্রাম্প তাকে ‘বাজে’ বলার পর অবশেষে জুলাই মাসে বরখাস্ত করেন। তবে এরপর আবার ট্রাম্প বলতেন, লেওয়ানডোস্কিকে ছাড়া তার নির্বাচনী প্রচারণায় ধস নেমেছে। তিনি বলতেন, ‘আমরা সবাই পরাজিত। আমাদের প্রতিটি লোক ভয়াবহ, কেউ জানে না তারা কী করছে... লেওয়ানডোস্কিকে ফিরিয়ে আনতে হবে’। এরমধ্যে প্রচারণা দলের দ্বিতীয় ম্যানেজার পল ম্যানাফোর্টের সাথেও তিক্ততা সৃষ্টি হয় ট্রাম্পের। আগস্টের নির্বাচনী বিতর্কে ট্রাম্প হিলারির কাছে ১২ থেকে ১৭ পয়েন্টে পিছিয়ে পড়েন। এর মধ্যে প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলো তার বিরুদ্ধে একের পর এক নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ করে ‘বোমা ফাটাতে থাকে’। পরিস্থিতি এতই খারাপ হতে থাকে যে, নির্বাচনে বিজয়ের কথাও চিন্তা করারও সুযোগ হয়নি তার। এমন দুঃসময়ে বুদ্ধি তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। কিছু বিষয় তার পরাজিত প্রচারণা দলের ওপর ছেড়ে দেন। এ সময় রিপাবলিকান দলে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী টেড ক্রুজের সমর্থক হিসেবে পরিচিত, ধনকুবের বব মারসার ট্রাম্পকে সমর্থন দেন। সেই সাথে প্রচারণার তহবিলে দেন ৫০ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান। ট্রাম্পের প্রচারণা আবারো জেগে উঠবে- এই বিশ্বাস নিয়ে মারসার ও তার মেয়ে রেবেকা লং আইল্যান্ড থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে যোগ দেন জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির উত্তরসূরি উডি জনসনের বাড়িতে তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে। মারসার ও তার মেয়ের সাথে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ কোনো সম্পর্ক ছিল না। আগে দু-একবার আলাপ হয়েছে মাত্র। কিন্তু তারা সমগ্র নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব নেয়ার পরিকল্পনাসহ একটি প্রস্তাব দেন এবং তাদের নিজস্ব লোক স্টিভ ব্যানন ও কেলিয়ানি কনওয়েকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়ার দাবি জানান। ট্রাম্প তাদের প্রস্তাব মেনে নেন। তিনি শুধু এটুকু প্রকাশ করেছিলেন যে, কেন তারা এই কাজ করছে তা বুঝে আসছে না। মারসারকে তিনি বলেন, ‘এসব খুবই বাজেভাবে চলছে’। আসলে ট্রাম্পের প্রচারণা তখন এমন একটি অবস্থায় ছিল, যার কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো ছিল না। স্টিভ ব্যানন যাকে বলতেন ‘ব্রোক ডিক ক্যাম্পেইন’।

No comments

Powered by Blogger.