সুবিধাবাদের দেয়াল ভাঙতে না পারলে সুশাসন অধরাই থেকে যাবে

আমাদের মতো দেশে সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা আর দেশপ্রেম থাকলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আমার মনে হয় কথাটির সত্যতা খুব কাছে থেকে অনুভব করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার সততা, দেশপ্রেম নিয়ে বিরুদ্ধ রাজনীতির অন্ধ মানুষ ছাড়া অধিকাংশ দেশবাসীরই সন্দেহ নেই। এর আগে দায়িত্ব পালন করা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা অনেক সরকারপ্রধানের বেলায় এমন মন্তব্য করা কঠিন। কারণ এদের বিরুদ্ধে নানা অসততা ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ সাধারণ মানুষ খুব একটা অবিশ্বাস করে না। কিন্তু সরকারপ্রধানের ক্লিন ইমেজ থাকার পরও কি আওয়ামী লীগ সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারছে? রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চারা কি মহীরুহে পরিণত হচ্ছে না? অথচ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ম্রিয়মাণ দশায় যেখানে জনসমর্থনে হেসেখেলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কথা, সেখানে নির্বাচন এলে এত দুশ্চিন্তা করতে হয় কেন? গোপন বা প্রকাশ্য জরিপে জনসমর্থনের সূচক নিম্নগামী হয় কেন? সাধারণ প্রচলিত কথা, ‘কোনো সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে তার জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হয়।’ প্রশ্ন হল, কেন এর উল্টোটি হবে না? যদি দেশে সুশাসন থাকে, রাজনৈতিক সততা থাকে তবে ছোট্ট নিন্দুক শ্রেণী ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ সেই সরকারকে বা সরকারে থাকা দলকেই সমর্থন জানাবে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের বাস্তবতায়, যেখানে অতীতে ক্ষমতায় থাকা দলগুলো তাদের কর্মভূমিকায় সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধই করেছে বেশি। দেশের নানা দৃশ্যমান অগ্রগতির কথা আমরা বলি, বাস্তবেও অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। সাদা চোখে যেসব সত্য স্পষ্ট, এর একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি।
এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। অনেক উড়াল সেতু হয়েছে। চার লেন-ছয় লেনের সড়ক হয়েছে, হচ্ছে। পদ্মা সেতু ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। মেট্রোরেলের কাজ চলছে। এসব মানার পরও বলতে হচ্ছে, সামাজিক জীবনে মানুষ কি স্বস্তিতে আছে? দেশের পরিবেশ কি বিপন্ন হচ্ছে না? রাজনৈতিক অসাধুতা আর দুর্বৃত্তায়নের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন কি বিপন্ন হচ্ছে না? এদেশের শিক্ষা বিস্তারের অঙ্গন কি কুসুমাস্তীর্ণ? ব্যাংকিং ক্ষেত্রে কি আর্থিক অনাচার চলছে না? খাল-নদী দখল কি সরকার রোধ করতে পারছে? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্রদের সন্ত্রাস কি দমন করতে পারছে সরকার? দেশজুড়ে খুনোখুনি কমছে? সরকারদলীয় নেতাদের কমিশন বাণিজ্য কি বন্ধ হয়েছে? ঋণখেলাপিদের প্রতি সরকারি সহানুভূতি কি কমেছে? অফিস-আদালত, বিশেষ করে সরকারের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘুষখোরদের তাণ্ডবে কি সাধারণ মানুষ পর্যুদস্ত হচ্ছে না? তাহলে এতসব অরাজকতা বহাল থাকার পর কেমন করে মানুষ ভাববে সুশাসনের পথে হাঁটছে সরকার? রাজনৈতিক শক্তির আশীর্বাদে বলীয়ান হয়ে যোগ্যদের কোণঠাসা করে অযোগ্যদের রামরাজত্ব কি চারপাশে আমরা দেখতে পাচ্ছি না? এসব বাস্তবতা বহাল থাকছে বলেই নির্বাচনের আগে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না সরকার ও সরকারি দল। লাগাম এক সময় হাতছাড়া হয়ে গেলে দুর্নীতির পাগলা ঘোড়াকে সেই লাগাম পরানো কঠিন। আমাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে লাগামের রাশ টানা কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো উপমহাদেশেই নির্বাচনে টাকার খেলা এখন ওপেন সিক্রেট। নির্বাচনী গণতন্ত্র এখন ভিন্ন চরিত্র পেয়ে গেছে। তাই এ যুগে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন কম হয়। মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে ভোটার সংগ্রহ, পেশিশক্তি সংগ্রহ, প্রশাসন ম্যানেজ করা সব ক্ষেত্রেই টাকা ঢালতে হয়। এ হচ্ছে এক রকম অদ্ভুত গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা। এতসব টাকা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না! জোগান দেন ব্যবসায়ীরা, ঘুষখোর আমলারা আর কমিশন বাণিজ্যে ফুলে ওঠা রাজনৈতিক নেতারা। সুতরাং এদের ঋণ খেলাপি হওয়ার মতো অন্যায় করার লাইসেন্স ক্ষমতাসীনদেরই দিতে হয়। ঘুষ খাওয়া তাদের অধিকারের পর্যায়ে পড়ে যায় আর বৈধতা পেয়ে যান তদ্বির বাণিজ্য ও কমিশন বাণিজ্যে যুক্ত নেতারা।
এ সূত্রেই সংসদে ক্রমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছেন ব্যবসায়ী ও আমলারা। তাদেরই কেউ কেউ সরকারদলীয় ফান্ডে পাঁচ কোটি কালো টাকা দান করেন পঞ্চাশ কোটি কালো টাকা আয় করার ভরসাতেই। এরপর এক সময় এসব টাকা সাদা করে ফেলাও কঠিন কিছু নয়। এমন বাস্তবতায় ক্ষমতার কাছে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা যাদের, তাদের পক্ষে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ রচনা করা কঠিন। ফলে সরকারগুলোর সাধ্য কি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে! এখন রাজনীতি করার সঙ্গে ধনী হওয়ার একটি স্বপ্ন-কল্পনা কাজ করে। তাই যে দলই ক্ষমতাসীন হয় সেদলের নেতাদের মধ্যে একটি দাবি তৈরি হয়ে যায় অর্থশালী হওয়ার পথ পাওয়ার। তাই অনেকেই প্রায় শূন্য থেকে বড় ব্যবসায়ী হয়ে পড়েন। ক্ষমতার দাপটে প্রচুর ব্যাংক ঋণ পেতে থাকেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তদ্বির বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্যে ফুলে উঠতে থাকেন। বড়দের দেখে ছোটরাও দাবিদার হয়ে পড়ে। গ্রামগঞ্জে সর্বত্র এদের দাপট দেখা যায়। লাইসেন্স বাগিয়ে রাতারাতি অনেকে ঠিকাদার বনে যান। লুটেপুটে খেতে থাকেন সবাই। বাঘ রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে তাকে নিবৃত্ত করা কঠিন। আর ক্ষমতার রাজনীতির সাধারণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এদের কিছু একটু দিয়ে পেলেপুষে না রাখলে দল চালাবেন কেমন করে! সুতরাং রাজনৈতিক শক্তিকে ঠিক রাখতে হলে হাজার দেশপ্রেম ও সততা নিজের মধ্যে অটুট থাকার পরও শেখ হাসিনার মতো দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া খুব সহজ নয়। ফলে এক ধরনের আপসরফাতেই যেতে হয়। কিন্তু এসবের কারণে যে যাতনা সৃষ্টি হয়, এর বিষময় ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকেই। এভাবেই দলের প্রতি জনআস্থায় ফাটল ধরে। আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টির একটি বড় কারণ দাপুটে ছাত্রলীগের আচরণ। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরোধীদলীয় ছাত্রদের সক্রিয় অবস্থান নেই বললেই চলে। তাই মাঝে মাঝে সন্ত্রাসী হাত নিশপিশ করে বলে তারা নিজেরা নিজেরাই মারামারি করে। ছাত্রলীগ-সন্ত্রাসীদের আচরণে কেউ কারও চেয়ে এখন কম যায় না। গত সপ্তাহে পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে রুম ছাড়া করেছে ছাত্রলীগের ছাত্রীরা। মেয়েটি এই শীতের রাতে হলের বাইরে কাটিয়ে পরদিন প্রতিবাদে অনশন শুরু করেছিল। দাপুটে ছাত্রীরা জানিয়েছে, মেয়েটি নেত্রীদের কথা না শুনে ‘বেয়াদবি’ করেছে, তাই শাস্তি ভোগ করেছে। এখন হলগুলোতে এরাই রাজা-রানী। মাঝে মাঝে তাদের আচরণে মনে হয়, হল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের অনেকটা তারা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। এখন এই ‘বেয়াদবি’ কথাটি এদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে প্রচলিত। ছাত্রনেতা খবর পাঠালে যদি আসতে দেরি হয়, ছাত্রলীগের রাজনীতি না করলেও মিছিলে যদি না আসে, এমনকি ছাত্রনেতাদের অনুমতি ছাড়া কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও নাকি বেয়াদবির সংজ্ঞায় ফেলা হয়। এজন্য নানা শাস্তির বিধানও থাকে। একবার তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তোমার এসএসসি-এইচএসসির রেজাল্ট এত ভালো, বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন ভালো হচ্ছে না কেন? ছেলেটি এক ভয়ঙ্কর কথা শোনাল। বলল, স্যার প্রথম বর্ষেই আমরা পিছিয়ে পড়ি। প্রথমত, হলে সিট না পাওয়ায় ‘গণরুমে’ থাকতে হয়। সেখানে পড়ার পরিবেশ থাকে না। তার ওপর আছে ছাত্রলীগের খবরদারি। মিছিলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক। ক্লাস-পরীক্ষার দোহাই দিলেও লাভ হয় না। তখন এ ধারার বেয়াদবির জন্য শাস্তি ভোগ করতে হয়। ফলে প্রথমবর্ষে ওরা লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়ার সুযোগই পায় না। কয়েক বছর আগেও সব সরকারের আমলেই সরকারি দলের ছাত্রনেতারা অন্য সতীর্থদের ওপর এমন চড়াও সাধারণত হতো না। মিছিলে লোক ভারি করার ব্যাপারে সতর্ক থাকত। অনেকটা বিটিভির মতো।
বিটিভির খবরের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি দর্শককে এক রকম জোর করে খবর দেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বেসরকারি চ্যানেলগুলোকে বাধ্য করে বিটিভির খবর প্রচারের জন্য। তেমনি সে সময় মিছিলে ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য হলের কলাপসিবল গেট বন্ধ করে চাবি নিয়ে নেয়া হতো। এখন ব্যবস্থাটি নাকি আরও আধুনিক হয়েছে। মিছিল শুরু হওয়ার আগে মোবাইল ফোনে মেসেজ আসে। তখন যে যেই অবস্থায় থাক না কেন, এমনকি ক্লাসে থাকলেও বেরিয়ে মিছিলে অংশ নিতে হবে। না হলে বেয়াদবির শাস্তি অবধারিত। যেহেতু আমরা পরিবার-সমাজ বিচ্ছিন্ন নই, এসবের বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। ছাত্রনেতাদের এসব বাড়াবাড়ির জন্য ভুক্তভোগী মানুষ মূল দলকেই দায়ী করবে। আওয়ামী লীগ নেতারা অনিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা তেমন করেছে এমন প্রমাণ দেয়া কঠিন। এভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের এতসব উল্লেখযোগ্য অর্জন মুহূর্তেই নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে নানা দলীয় অনাচার। নির্বাচন এলে এসব হিসাব-নিকাশ সামনে চলে আসে। এ কারণেই গণতন্ত্রের সরল রূপ দেখার মতো সাহস থাকে না আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর। সুযোগ আর ক্ষমতা ব্যবহার করে নানা কৌশলে নির্বাচন নিজেদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করে। এভাবে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতো করেই গণতন্ত্র বুঝতে চান। এদেশের বাস্তবতায় আমরা নিশ্চিত আওয়ামী লীগকে যদি লোভী মানুষগুলো কলঙ্কিত করতে না পারত, তাহলে গণতন্ত্রের পথে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগের সমকক্ষ কাউকে পাওয়া যেত না। কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী দলটির ভেতরে যেভাবে লোভী আর অসৎ মানুষের অবস্থানের কথা শোনা যায়, তাতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার সব ক্ষেত্রে দৃঢ় থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তার মধ্যে ব্যক্তিগত সততা ও দেশপ্রেম থাকলেও বর্তমানে চারপাশে তৈরি করা সুবিধাবাদের দেয়াল না ভাঙতে পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভবই বলতে হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.