তীব্র শীতে কাঁপছে দেশ : ১০ জনের মৃত্যু

তীব্র শীতে কাঁপছে দেশ। উত্তরাঞ্চলের মানুষ কাঁপছে ঠক ঠক করে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ায় গতকাল সোমবার তাপমাত্রা নেমেছিল ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এটিই ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বনিম্তা মাত্রা। এর আগে ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রংপুর বিভাগের অবশিষ্ট জেলাগুলোতেও গতকাল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করে।। গতকাল সৈয়দপুরে তাপমাত্রা নেমে যায় ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এসব অঞ্চলে প্রচণ্ড শীতে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত। গতকাল শীতে পাবনায় ছয়জনসহ মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। হঠাৎ এত ঠাণ্ডা নেমে আসায় মানুষের একেবারে দিশেহারা অবস্থা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা মোকাবেলার প্রস্তুতি না থাকায় কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। এক সময়ের মঙ্গাপ্রবণ রংপুর বিভাগের সর্বত্রই অভাবী মানুষের বাস। এরা অনেকেই নদীতীরবর্তী চরাঞ্চলে অথবা বিশাল ফসলের মাঠে অথবা বড় রাস্তার পাশে খড়ের তৈরি ছাউনি ও বেড়া নির্মাণ করে বাস করে। মুষ্টিমেয় কিছু ছাড়া রংপুর বিভাগে বেশির ভাগ কাঁচা ঘরবাড়িতে বাস করে মানুষ। ঘরে আশ্রয় নিয়েও কনকনে শীত প্রতিরোধ করতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। এ এক অসহনীয় অবস্থা। না রাতে ঘুমিয়ে শান্তি পাওয়া যাচ্ছে, না দিনে কাজে বের হয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন। শান্তিতে রাত কাঠানোর জন্য না আছে ভারী লেপ-কম্বল এবং দিনের বেলা কাজে বের হওয়ার জন্য না আছে উপযুক্ত গরম জামা-কাপড়। হাঁড় কাঁপানো এ শীত শুধু যে রংপুর বিভাগে তা নয়। রাজশাহী বিভাগেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়ায় নাকাল অবস্থা মানুষের। তবে রংপুর বিভাগের চেয়ে রাজশাহী বিভাগে ঠাণ্ডা তুলনামূলকভাবে একটু কম। আবহাওয়া অফিস বলছে, দু’টি বিভাগেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, ১৯৪৮ সাল থেকে আবহাওয়া অফিসে তাপমাত্রার রেকর্ড রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে ১৯৬৮ সালে শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্রা নামে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কিন্তু আজকে (গতকাল সোমবার) তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা শ্রীমঙ্গলের রেকর্ড ভেঙেছে। রাজধানী ঢাকায় রংপুর অথবা রাজশাহী বিভাগের মতো এতটা ঠাণ্ডা পড়েনি। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এখানে অল্প পরিসরে গাদাগাদি করে বাস করে বলে ঢাকার তাপমাত্রা খুব বেশি নামে না। ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নেমে গেলেই খুব অস্বস্তিতে পড়েন ঢাকাবাসী। এখানে পাকা ভবনে যত মানুষ বাস করেন তার চেয়ে বেশি মানুষ বাস করেন শহরের মাঝখানে সরকারি জমিতে, রেল লাইনের পাশে ও নিম্নাঞ্চলে। এসব মানুষ বেশ বেকায়দায় পড়েছেন হঠাৎ এ প্রচণ্ড শীতে। প্রচণ্ড শীতে মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। কারো ডায়রিয়া, কেউ ভুগছেন হাঁপানিতে। আবার সর্দি-কাশি খুবই সাধারণ বিষয়। কেউ কেউ ভুগছেন প্রচণ্ড মাথা ব্যথায়। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকেরা সর্দি-কাশি, হাঁপানি ও ডায়রিয়ার রোগী বেশি আসছেন বলে জানান। চিকিৎসকদের চেম্বারে এত রোগী আসছেন যে রাত পর্যন্ত তাদের চেম্বারেই থাকতে হচ্ছে। শীত নামলেই প্রতি বছরই চাহিদা বাড়ে গরম কাপড়ের। রাজধানী ঢাকায় কম্বলের বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে পাতলা কম্বল সাধারণ সময়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি সেটা এখন এক হাজার টাকায়ও বিক্রি করছে না। সাধারণ মানের গরম সুয়েটার আগে ২০০-৩০০ টাকায় বিক্রি হতো এগুলোই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলের ফুটপাথে গিয়ে দেখা গেছে, দামা-দামি করার সুযোগই দিচ্ছে না বিক্রেতারা। এক দামে বিক্রি করে শেষ করতে পারছে না। আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানান, হিমালয় অঞ্চলের হিমশীতল বায়ুপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে নেমে আসায় এবং শুষ্ক বাতাস, ঘন কুয়াশা, ঊর্ধ্বাকাশের জেট বায়ু ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে আসার কারণেই তাপমাত্রা এত বেশি নিচে নেমেছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জেট বায়ু খুবই ঠাণ্ডা থাকে। এটি স্বাভাবিক সময়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সময় এটি ১০ থেকে ২০ হাজার ফুটে নেমে আসে। এ বছর জানুয়ারির শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঠাণ্ডা বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। গত ৩ জানুয়ারির বিকেল থেকেই দেশের অর্ধেক অঞ্চল মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের আওতায় চলে আসে। গত ৪ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা নামে সাড়ে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এরই ধারবাহিকতায় গত দুই দিন থেকে কয়েকটি স্থানে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছেন, চলতি শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা দুই থেকে তিন দিন পর ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। তবে আগামী পাঁচ দিন পর তাপমাত্রা অনেকটাই বাড়তে শুরু করবে।
কারণ আন্দামান সাগরে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়ে গতকাল বিকেল পর্যন্ত তা অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তংসংগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। লঘুচাপটি আরেকটু অগ্রসর হলে তা দেশের তাপমাত্রার ওপর প্রভাব ফেলবে। ধীরে ধীরে শৈত্যপ্রবাহকে আরো উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ঠেলে দেবে। তখন তাপমাত্রা একটি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসতে পারে। গতকাল পর্যন্ত রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ ছাড়া টাঙ্গাইল, শ্রীমঙ্গল, চুয়াডাঙ্গা এলাকায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। আজ মঙ্গলবারও এসব অঞ্চল ছাড়া তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আওতা বাড়বে যশোর অঞ্চলেও। আজ ময়মনসিংহ, বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের অবশিষ্ট অঞ্চল এবং সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে বয়ে যেতে পারে মৃদু থেকে মাঝারি (৬.১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধরনের শৈত্যপ্রবাহ। আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্বাভাসে বলা হয়েছে রাতের তাপমাত্রা সকাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলেও দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পাবে। নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীতে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশা অব্যাহত রয়েছে। রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়েছে। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকছে সব কিছু। তবে গত চার দিন পর সোমবার গতকাল নীলফামারীতে সূর্যের দেখা মিলেছে। এ দিকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় গতকাল সকালে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া সৈয়দপুর উপজেলায় ৩ দশমিক ৫ ও নীলফামারী সদর, ডোমার ও জলঢাকা উপজেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। নীলফামারী জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা এ টি এম আখতারুজ্জামান জানান, এ পর্যন্ত জেলায় ৪১ হাজার ৯৩৭টি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। শিশুর পোশাকসহ আরো ২০ হাজার কম্বলের চাহিদা দেয়া আছে বলে তিনি জানান। সৈয়দপুর (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীর সৈয়দপুরে কনকনে ঠাণ্ডা ও শৈত্যপ্রবাহ চলছে। এতে গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্টে পড়েছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। ফলে লোকজন খড়কুটা, কাগজ ইত্যাদি জ্বালিয়ে শীতের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। নীলফামারীর সৈয়দপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হাকিম জানান, গতকাল সোমবার সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সৈয়দপুরে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। সাদা মেঘের ভেলায় ঢাকা পড়েছে পুরো জনপদ। চার দিক কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে। বৃষ্টির মতো ঝিরঝির করে কুয়াশা ঝরছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীর গতিতে চলাচল করেছে সকাল ও ভোরে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বা মোড়ে জ্বালানো হয়েছে আগুনের কুণ্ডলি। চালক ও পথচারীরা হাত ও শরীর আগুনে তাপিয়ে নিয়ে গন্তব্যে ছুটছেন। দোকানিদের প্রতিষ্ঠানের খড়কুটা জ¦ালিয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে। এ দিকে শীতজনিত রোগে হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুরা সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। যশোর অফিস জানায়, শৈত্যপ্রবাহে অচল হয়ে পড়েছে যশোরের জনজীবন।
স্থবির হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। কেউ কোনো কাজকর্মে যেতে পারছেন না। ঘন কুয়াশায় যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। গতকাল সোমবার যশোরের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষও শীতে কষ্ট পাচ্ছেন। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। শীতের সাথে প্রচণ্ড কুয়াশা থাকায় যান চলাচলও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে সকাল ১০টার দিকে কুয়াশা ভেদ করে সূর্য ওঠার পর এ অঞ্চলের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়তে শুরু করে। যশোর জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া সংবাদদাতা জানান, গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। গতকাল সোমবার সকালে এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত চার দিনের মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের পর রোববার রাত থেকে শুরু হয় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। গতকাল ভোর থেকেই ভারী কুয়াশায় ঢেকে যায় জেলার সব এলাকা। ভোরে দুই হাত সামনের জিনিসও ভালোমতো দেখা যায়নি। তবে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সূর্যের মুখ দেখা যাওয়ার পর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক তৌহিদুল ইসলাম জানান, সোমবার সকাল ৬টার সময় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার সকাল ৯টায় রেকর্ড করা হয় সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। গতকাল বেলা ৩টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তিনি আরো জানান, একই অফিসের গ্রাস থার্মোমিটারে গতকাল সকাল ৬টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ দিকে পঞ্চগড়ের শীতার্ত মানুষদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য গতকাল রাতে পঞ্চগড়ে পৌঁছেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তিনি পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহলে শীতবস্ত্র বিতরণ করবেন। সেখানে শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে তিনি বোদা উপজেলার পাইলট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে ঠাকুরগাঁও যাবেন। রাজবাড়ী সংবাদদাতা জানান, রাজবাড়ীতে শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোটা ভাইরাস ও ডায়রিয়ার প্রকোপ। এ ছাড়া এখানে এক সপ্তাহ ধরে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ। বিশেষ করে রাজবাড়ীর পদ্মা নদী ভাঙনের শিকার বেড়িবাঁধ ও জেগে ওঠা চরাঞ্চলে ঝুপড়ি পেতে আশ্রয় নেয়া ছিন্নমূল পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধরা এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। রোটা ভাইরাস ও ডায়রিয়ায় আক্রান্তরা প্রতিদিনই রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের শিশু ও ডায়রিয়া বিভাগে ভর্তি হচ্ছে। এ রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় এ হাসপাতালে শয্যার সঙ্কটে অনেক রোগীতে ফ্লোরে আশ্রয় নিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। যার বেশির ভাগই শিশু। পাশাপাশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন বয়স্করাও। লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা জানান, মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে গত কয়েক দিনে শীতের তীব্রতা, ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। এ অঞ্চলে দিনদিনই কমছে তাপমাত্রা, বাড়ছে শীত। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ জেলে ও কৃষক হওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছে তারাই। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও শ্রমজীবীসহ সাধারণ মানুষ। এসব নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের শীত নিবারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সকাল, দুপুর, বিকেল ও রাতে সব সময় কন কনে বাতাশের সাথে তীব্র শীতে নাকাল শিশু ও বৃদ্ধরা। শীত নিবারণের জন্য মানুয় খড়কুটা জ্বালিয়ে সাময়িক শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। শীতের তীব্রতার করণে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হচ্ছে। গত এক সাপ্তাহ ধরে দিনে ও রাতে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়া শীতের তীব্রতা আরো বাড়ছে। মওসুমি শীতের প্রভাবে মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলেও কষ্ট লক্ষ করা গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর সব হাটবাজারের ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছেন। রাতে মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরে হচ্ছেন না। দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) সংবাদদাতা জানান, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে বলে এলাকার কৃষকেরা জানিয়েছেন। ধানের বীজতলা, সরিষা, মসুরি নষ্ট হতে পারে। কয়েক দিন ধরে আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন রয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে, শিশুদের পাশাপাশি বয়স্করাও ঠাণ্ডজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে উপজেলা ও সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় ধান বিজতলা কিছুটা বিনষ্ট হতে পারে তবে অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে সে ধরনের আলামত দেখা যায়নি। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, গতকাল সোমবার ফের তাপমাত্রা নেমে চুয়াডাঙ্গায় ৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। উত্তরের বাতাস বইছে। খড়কুটায় আগুন জ্বালিয়ে মানুষ শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার ভাঙনকবলিত পদ্মা পাড়ের বাসিন্দারা গত ক’দিন ধরে তীব্র শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এসব মানুষ পদ্মা নদীর পাড়ে, বিভিন্ন বেড়িবাঁধ, ও উন্মুক্ত ফসলি মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার বসবাস করছে। পদ্মার তুষারাচ্ছন্ন বাতাস আর হাড়কাঁপানো শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে নারী, শিশু, বৃদ্ধরা গবাদিপশু নিয়ে খড়কুটা ও ছালা জড়িয়ে বেঁচে আছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগ শ্রমজীবী, মজুর ও জেলে পরিবার। চলতি বোরো মওসুমে গ্রামাঞ্চলে ইরি ও বোরা ধান রোপণের ধুম পড়েছে। তাই ধান রোপণের কাজগুলো কাদা পানির বলে তীব্র শীতে বৃদ্ধ কৃষক ও শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সেই সাথে পরিবারের শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশুর মধ্যে দেখা দিয়েছে ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মানস বসু জানান, ‘এ বছর সরকারিভাবে আমরা ১ হাজার ২০০ পিস কম্বল পেয়েছি। উপজেলার প্রতিটি দুস্থ পরিবারে সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করেছি।’ কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, টানা আট দিনের তীব্র শৈত্যপ্রবাহে কুড়িগ্রামের জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। কুড়িগ্রামের কৃষি আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক সুবল চন্দ্র সরকার জানান, সোমবার এ অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা এ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কনকনে ঠাণ্ডা ও উত্তরের হাওয়ায় ঘর থেকে বের হতে পারছেন না মানুষ। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন শিশু ও বৃদ্ধরা।
গত কয়েক দিনে রাত ও দিনের তাপমাত্রার তারতম্য না থাকায় কাজে বের হতে পারছেন না শ্রমজীবী মানুষ। গরম কাপড়ের অভাবে সর্বত্রই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছে নি¤œ আয়ের মানুষজন। তীব্র ঠাণ্ডায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ। তবে সোমবার বেলা ১১টা থেকে সূর্যের দেখা মেলায় একটু স্বস্তি ফিরে এসেছে শীতকাতর মানুষের মাঝে। কুড়িগ্রাম শহরের ভ্যানচালক মোকছেদ মিয়া জানান- এমন ঠাণ্ডা, হাতও বের করা যায় না। তারপরও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় কোনো ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের সোহরাব আলী জানান, নদীর পাড়ে বাড়ি। ঠাণ্ডায় ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। কাজও চলে না। গরম কাপড়ও নাই। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। এ দিকে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী। কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা: শাহিনুর রহমান সরদার জানান, শীতের তীব্রতা বাড়ায় সদর হাসপাতালে শিশু ও বৃদ্ধ রোগী বাড়ছে। বর্তমান হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৩১ জন শিশু রোগী ভর্তি রয়েছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশু ও বৃদ্ধসহ ২১ জন ভর্তি রয়েছে। এখন পর্যন্ত সদর হাসপাতালে শীতজনিত রোগে কোনো রোগী মারা যায়নি বলে জানান তিনি। হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট থাকলেও যথাসাধ্য চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, সরকারের কাছে থেকে আমরা ৫৭ হাজার শীতবস্ত্র পেয়েছি, যা অতীতের চেয়ে বেশি। শীতবস্ত্র যথাযথভাবে যাতে বিতরণ হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। জেলায় দুস্থ মানুষ যারা আছেন তাদের তালিকা করে কম্বল পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। আমরা আরো কম্বল চেয়েছি। আশা করছি সেটি পেয়ে যাব এবং দ্রুত শীতার্ত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারব।

No comments

Powered by Blogger.