আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের কষ্ট by ম্যাথিউ সল্টমার্শ

মিয়ানমারের নৃশংসতায় কমপক্ষে ৬ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা তাদের বাড়িঘর ছেে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনহীন, নিঃসঙ্গ অবস্থায় এভাবে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন ১৮ বছর বয়সী কিশোরী সাহার। তার মা, পিতা ও ভাইদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই নারকীয় আগুনের বীভৎসতা থেকে কোনো রকমে নিজের জীবনটাকে বাঁচিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন তিনি। সাহার এখন বাংলাদেশের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে নিঃসঙ্গ বসবাস করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এমন লাখো লাখো রোহিঙ্গার মতো তিনি একজন।
আলো-ছায়ার মধ্যে তিনি জীবনকে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। কোনোমতে পেরিয়ে যাচ্ছে দিন। আসছে রাত। আবার দিন। তিনি জীবনের ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন তিনি কি কখনো বিয়ে করতে পারবেন!
সাহারের মতো রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জানতে শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের হাই কমিশনার ইউএনএইচসিআর কুতুপালং,নয়াপাড়া ও কিরোণতলি/চাকমারকুল আশ্রয়শিবিরে ৫ শতাধিক আশ্রিতার ওপর একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। তাতে দেখা গেছে, ওই সব আশ্রয় শিবিরে গাদাগাদি করে অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। তাদের বসবাসের পরিবেশ নাজুক। এতে তাদের অবস্থা সম্পর্কে অনেক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এত কঠিন অবস্থা সত্ত্বেও নিজের দেশে যতটুকু তার চেয়ে বাংলাদেশের পরিবেশকে নিরাপদ মনে করছে। তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে সবাই।
আশ্রয় শিবিরে সাহারের আকাঙ্খার কথা ফুটে উঠেছে। বাঁশ আর তারপুলিনের তৈরি আশ্রয় শিবিরে তার রাত কাটে একাকী। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। দিনের বেলা তিনি নিকট প্রতিবেশী এক বিধবা নারীর সঙ্গে সময় কাটায়। তারা একসঙ্গে পানি সংগ্রহ, কাঠ সংগ্রহ ও খাদ্য যোগাড়ের মতো কাচ করেন।
অন্তত কোনো দিক দিয়ে সাহারের সৌভাগ্য। তার একটি দোকান আছে। এ ছাড়া তার আঘে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির একটি ফুড কার্ড। তার ওপর চোখ আছে স্থানীয় সম্প্রদায়ের এক নেতা বা মাঝির। হেসে দিয়ে সাহার বলেন, আমার খুব ভয় হয়। তবে প্রয়োজন হলে আমি সাহায্য পাবো।
জরিপের আওতায় নেয়া হয় নারী, পুরুষ, স্থানীয় নেতা, সিঙ্গেল পরিবার, বয়স্ক মানুষ ও বিকলাঙ্গদের। গত মাসে স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে বিপন্ন এমন মানুষদের ঘটনা সনাক্ত করে তা ইউএনএইচসিআরের কাছে জানানোর জন্য গত মাসে ওই জরিপ পরিচালনা করা হয় অংশীদারদের সঙ্গে। এর উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা সনাক্ত করা।
জরিপে যেসব বিষয়ে উদ্বেগকে জোরালো হিসেবে দেখানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রাতের বেলায় নিরাপত্তাহীনতা। রয়েছে নাজুক আশ্রয় শিবির ও আলোর স্বল্পতা। রয়েছে ডাকাতি ও শিশু পাচারের ঝুঁকি। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগে রয়েছে ঘাটতি। অথচ এসবই প্রয়োজন ছিল।
উপরন্তু পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা খুবই সীমিত। এর ফলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে লম্বা লাইন দিতে হয়। ল্যাট্রিনগুলো ভরে গেছে। নারীদের গোসলের প্রাইভেট জায়গার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে অনেক নারীর।
তিন সন্তানের মা, বিধা মারজিয়া। শুধু নারীদের গোসলখানা এমন সুবিধা পেতে তাকে পূতি গন্ধময় একটি স্থানে হেঁটে যেতে হয় কয়েক শত মিটার হেঁটে। এর অর্থ হলো তিনি সপ্তাহে একবার গোসল করতে পারেন। বড়জোর দু’বার। তার ধারেকাছে শুধু নারীরা ব্যবহার করতে পারবেন এমন ল্যাট্টিন আছে মাত্র একটি। মারজিয়া বলেন, সবারই প্রাইভেসি এখানে সীমাবদ্ধ। তিনি বলেন, রাতে আমরা পর্যাপ্ত আলো পর্যন্ত পাই না।
জীবনের সবচেয়ে জটিল বিষয়টি হলো নিত্য পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে লম্বা লাইন। মারজিয়া বলেন, আমাদেরকে রান্না করতে হয় সূর্য ডোবার আগে। আমাদের নেই পর্যাপ্ত বাসনকোসন, মশলা, মাছ, মাংস, শাকসবজি। শিশুরা শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। দূর থেকে তাদেরকে পানি আনতে হয়। বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে হয় রান্নার জন্য। ইউএনএইচসিআর দেখতে পেয়েছে, এরপরে শিশুরা কুলি হিসেবে কাজ করে। কিনউ পিতামাতা ও শিশুরা চায় শিক্ষা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ।
স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সীমিত তথ্য হলো আরেকটি উদ্বেগের কারণ। চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র অনেক দূরে থাকার কারণে জটিল রোগে ভুগছেন এমন অনেকের চিকিৎসা দেয়া হয় না। এখানে রয়েছে মারাত্মক রকম হতাশা ও কোনো কিছু সহজেই প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা। বিশেষ করে বয়স্ক ও বিকলাঙ্গদের মধ্যে এটা দেখা যায়। যুব শ্রেণি আনমনা থাকে। তারা ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চিত।
এসব উদ্বেগ ও ক্লেশ সত্ত্বেও ব্যাপকহারে মানুষকে পালিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। এতে মনে হতে পারে সেখানে সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। নারী ও যুব শ্রেণী বলেছে তারা নিত্যদিন খাদ্য ভাগাভাগি করে খান। একজন অন্যজনকে সহায়তা করেন। ক্লিনিকে অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা দেন। রান্নায় সহায়তা করেন।
সেখানে উন্নততর তথ্য কেন্দ্র (ইনফরমেশন পয়েন্ট) প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে ইউএনএইচসিআর এবং পরিকল্পনায়ও রয়েছে তা। এক্ষেত্রে স্টাফ ও অংশীদারদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করা হচ্ছে। দু’ভাবে যোগাযোগ বিষয়ক সার্ভিস শক্তিশালী করা যেতে পারে। তার এক হলো কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করে, যেখান থেকে মানসিক সেবা দেয়া যেতে পারে। দুই হলো, জটিল ও কঠিন মানসিক সমস্যার সেবা কেন্দ্র। সেখান থেকে লিঙ্গগত সহিংসতা ও শিশুর নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
লাইন ধরে সহায়তা নেয়ার ক্ষেত্রে যাতে লাইন কমিয়ে আনা যায় তার জন্য এরই মধ্যে কাজ করছে ইউএনএইচসিআর। অক্ষম ব্যক্তিদের কাছে সরাসরি সহায়তা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শিশু শ্রম কমিয়ে আনার জন্য জ্বালানি কাঠ ব্যবহারের বিকল্প ব্যবস্থা দেয়া হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে পরিবেশগত সচেতনতা। বাড়ানো হচ্ছে গোসলখানার সুবিধা ও নারীদের জন্য ল্যাট্রিনের সুবিধা।
(ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.