‘ভেজাল সুলতান’

যেখানেই জমির মালিকানা নিয়ে ভেজাল, সেখানেই হাজির সুলতান আহমেদ মৃধা। প্রতিবেশীর বসতবাড়ি, অন্যের কেনা জমি, কৃষকের ধানি জমি, সরকারের খাসজমি—কাগজপত্রে কোনো সমস্যা থাকলে ঢুকে পড়েন সুলতান। আবার ভুয়া দলিল তৈরি করেও হাজির হন তিনি। এই সুলতান পটুয়াখালীর নারী সাংসদ লুৎফুন নেছার স্বামী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ২০১৪ সালে লুৎফুন নেছা পটুয়াখালীর সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ হন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের অভিযোগ, কার্যত এরপর থেকেই এলাকায় সুলতান মৃধার জবরদখল বাড়তে থাকে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, স্ত্রী-পুত্রসহ সুলতান মৃধার নামে-বেনামে প্রায় ২০০ একর সম্পত্তি আছে। এর কিছু একাধিক ব্যক্তি নিয়ে কেনা, কিছু বায়না করা, কিছু সরাসরি জবরদখল করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতান আহমেদ মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ভেজালের কোনো রেকর্ড নেই। বরং আমরা কিনলে অন্যরা ভেজাল করার চেষ্টা করে। পারিবারিকভাবে আমরা ব্যবসায়ী। ১৯৮০ সাল থেকে আমাদের হাজী অ্যান্ড সন্স ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর স্থানীয় এজেন্ট। পটুয়াখালীতে আমরা দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে বসবাস করছি।’ সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আপনি আনুমানিক ২০০ একর জমির মালিক হয়েছেন।’ এ তথ্য শুনেই সুলতান মৃধা বললেন, ‘তারা মাইপ্পা বুঝায়া দিক। আমার ব্যক্তিগত জমি ২০ একরও হবে না।’ যদিও সংসদ নির্বাচনের সময় স্ত্রী লুৎফুন নেছা হলফনামায় তথ্য দিয়েছিলেন যে স্বামী সুলতান আহমেদ মৃধার নামে কৃষিজমি আছে ৭ একর ৫০ শতাংশ এবং অকৃষিজমি আছে ৭ শতাংশ। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে অন্তত ১০টি জায়গার ঠিকানা মিলেছে, নামে-বেনামে যেগুলোর মালিক সুলতান মৃধা। পটুয়াখালী শহর থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত এলাকায় এই জায়গাগুলোর অবস্থান। যেখানে সুলতান, তাঁর সাংসদ স্ত্রী, ছেলে ও ব্যবসায়িক বন্ধুবান্ধবের নামে সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে। সুলতান পটুয়াখালী পৌরসভা ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। একসময় বিএনপির রাজনীতিও করেছেন। এলাকায় তিনি খুবই প্রতাপশালী। তবে সুলতান মৃধা বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। দলীয় একজন সদস্যের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. শাহজাহান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তার (সুলতান মৃধা) জমি দখল কয়টার কথা বলমু। সে যুধিষ্ঠির সাহার জায়গা দখল করে বিল্ডিং করেছে। কারও বাড়ি দখল, কারও জমি দখল করছে। হিন্দু-মুসলমান বলে কথা নেই। কিন্তু কেউ যে কিছু বলবে, সেই সাহস নেই। কারণ তাদের পেছনে বাহিনী আছে। পুরান বাজারের মানুষ তো জিম্মি।’ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে সুলতান মৃধা লোকজন দিয়ে ভেজাল জমি খোঁজেন। এরপর পরিকল্পনামাফিক তাতে নিজেকে জড়ান। তারপর কখনো ‘ক্রয়সূত্রে’ আবার কখনো ‘বায়নাসূত্রে’ মালিকানা দাবি করে দলবল নিয়ে সাইনবোর্ড টাঙান।
দখলে আমমোক্তারনামা ব্যবহার
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে স্ত্রী লুৎফুন নেছা সাংসদ হওয়ার মাসকয়েকের মাথায় সুলতান মৃধা দখল করেন পটুয়াখালী  শহরের কলেজ রোডের ভেটেরিনারি হাসপাতাল-সংলগ্ন সাজ্জাদুর রহমান খান ও হাফিজ আল আসাদের (দুই ভাই) ১৪ শতাংশ জমি। পরের বছরের ডিসেম্বরে তাঁদের বাবা সামসুর রহমান খানের ‘নকশী’ বাড়িতে সাইনবোর্ড টাঙান তিনি। সেখানে জমির পরিমাণ ১০ শতাংশ। দলিলপত্রে দেখা যায়, সাজ্জাদুর ও হাফিজ ২০১২ সালে ৬০ লাখ টাকা মূল্যে সাব-কবলায় এই জমি কেনেন। আর ‘নকশী’ বাড়িটি কেনাবেচা হয় ২০১১ সালে। নগদ ৩৮ লাখ টাকায় এই বাড়ি বায়না রেজিস্ট্রি হয় সামসুর রহমানের নামে। নকশীর বিক্রেতা শহরের বাসিন্দা জামাল আফরোজ আর পাশের ১৪ শতাংশ জমির বিক্রেতা ইকবাল আফরোজ ও জামাল আফরোজ। তাঁরা দুই ভাই। ২০১২ সালে কেনা সাজ্জাদদের জমিটি সুলতান মৃধা দখল করেন ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর। সাইনবোর্ড ঝোলান তাঁর স্ত্রী সাংসদ লুৎফুন নেছার নামে। কাগজপত্রে দেখা যায়, এই দখলদারির জন্য ইকবাল ও জামালের আরেক ভাই কামাল আফরোজের কাছ থেকে সুলতান মৃধা একটি আমমোক্তারনামা নেন। বায়না রেজিস্ট্রির চার বছর পর করা এই আমমোক্তারনামা নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠেছে। আবার ওই মোক্তারনামার অন্যতম সাক্ষী তাঁর স্ত্রী লুৎফুন নেছা। বায়না রেজিস্ট্রি দলিল ও এ-সম্পর্কিত নথিপত্রে দেখা যায়, ‘নকশী’ নামের একটি পুরোনো দালানঘরসহ ১০ শতাংশ জমির দর ঠিক হয় ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বায়না রেজিস্ট্রির দিন ৩৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেন সামসুর রহমান। বাকি থাকে ৮ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে সামসুর রহমান খবর পান, এই জমির অনুকূলে মালিক জামাল আফরোজ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (এইচবিএফসি) থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, যা সুদে-আসলে ৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা হয়েছে। ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ না করায় এইচবিএফসি জমির মূল দলিলের জন্য জামালকে নোটিশ দেয়। জমি রক্ষায় ক্রেতা সামসুর রহমান এইচবিএফসির চাহিদামতো ৯ লাখ ৫১ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। এরপরও সামসুর রহমানকে জমির মূল দলিল বুঝিয়ে দেননি জামাল আফরোজ। এই পর্যায়ে আইনজীবীর পরামর্শে সামসুর রহমান আরও ৮ লাখ টাকা আদালতে জামাল আফরোজের অনুকূলে জমা দেন। এই নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। দুই পক্ষের মামলা-মোকদ্দমার ভেতরে ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুলতান মৃধা দলবল নিয়ে ‘নকশী’ ভবনসহ জমির দখল নিতে প্রথমে ‘ক্রয়সূত্রে মালিক’ ও পরে ‘বায়নাসূত্রে মালিক’ দাবি করে সাইনবোর্ড টাঙান। এ নিয়ে মামলা হলে সুলতান আদালতে একটি আমমোক্তারনামা দেন। তাতে দেখা যায়, বায়না রেজিস্ট্রির চার বছর পর ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর জামাল আফরোজ এই জমির আমমোক্তারনামা দেন সুলতান মৃধাকে। পরে এই জমি গত বছরের ১৯ অক্টোবর স্ত্রী লুৎফুন নেছার নামে দলিল করে দেন সুলতান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতান মৃধা বলেন, ‘ওরা তো বিএনপি করে। তাই আমার বিরুদ্ধে জমি দখলের এই অপপ্রচার। জমি নিয়ে মামলা চলছে। আমি নিশ্চিত ওরা ঠকবো। এরপরও আমাদের আইনজীবী সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ওরা রাজি না। এখন ওরা যদি কোর্টে পায়, আমার কোনো আপত্তি নেই।’ সামসুর রহমান খানের স্ত্রী সালেহা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী তাঁর উপার্জনের সবটুকু দিয়ে জায়গাটি কিনেছেন। আমার দুই ছেলে দেশের সেবা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত। কোনো দিন ভাবিনি এমন অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হব।’
যুধিষ্ঠির সাহার জমিতে ভবন নির্মাণ
পটুয়াখালী শহরের লোহালিয়া নদীর পাড়ঘেঁষা পুরান বাজার এলাকায় ৫০ শতাংশ জমি নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে সরকারের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা যুধিষ্ঠির চন্দ্র সাহার মামলা চলছে। ২০১৫ সালে হঠাৎ যুধিষ্ঠিরের বসতঘরের সামনের ওই জায়গা দখল করে সীমানাপ্রাচীর দেন সুলতান মৃধা। অথচ সরকারের সঙ্গে লড়ে হাইকোর্টের রায়ে যুধিষ্ঠির সাহা জায়গার মালিকানা পান। সরেজমিনে দেখা যায়, ওই জায়গায় সুলতানের ডুপ্লেক্স বাড়ির নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যুধিষ্ঠির সাহা জে এল মৌজার ৬৯ শতাংশ জমির পৈতৃকসূত্রে মালিক। যুধিষ্ঠিরের বাড়ির সরু গলির ওপাশে সুলতান মৃধার বাড়ি। কথা বলে জানা গেছে, একসময় ভাঙনে যুধিষ্ঠির সাহার জমির বেশ কিছু নদীতে চলে যায়। পরে চর জাগলে যুধিষ্ঠির তা দখলে নেন। সরকারের ভূমি অফিস ওই জমি খাস বলে দাবি করে মামলা করে। ২০০১ সালে পটুয়াখালীর জেলা জজকোর্টের রায়ে যুধিষ্ঠির হেরে যান। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যান তিনি। ২০১৪ সালে হাইকোর্ট যুধিষ্ঠির সাহার পক্ষে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে জমির ওপর স্থিতাবস্থার আবেদন করে সরকারপক্ষ, যা শুনানির অপেক্ষায় আছে। যুধিষ্ঠির বনাম সরকারের মধ্যকার মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সুলতান মৃধা কী করে এলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুধিষ্ঠির সাহার পরিবারের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তায় ছিনতাই, ডাকাতি হয় কীভাবে? এই জমি দখলেও ঠিক তাই হয়েছে, বুকে পিস্তল ধরা হয়েছে। সুলতান মৃধা এই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওইটা আমার জমির মুখসা (সামনে)। আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। এই জমি নিয়ে আমার বিরুদ্ধে তো তাদের কোনো কমপ্লেইন নাই।’ এই দখলি জমির পাশে লোহালিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষে আরেকটি দোতলা ভবন করেছেন সুলতান মৃধা। এটিও করেছেন সরকারি ২০ শতাংশ জমি দখল করে। শহরের পালবাড়ির দরজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের জায়গা দখলেরও অভিযোগ আছে সুলতানের বিরুদ্ধে।
ইটভাটায় জমি দখল
‘এমএল কোং ব্রিকস’ নামে শহরের টাউন জৈনকাঠি এলাকায় ইটভাটা করেছেন সুলতান মৃধা। স্ত্রী লুৎফুন নেছার নামে এই ইটখোলা শুরুর সময় জমি ছিল ৩০০ শতাংশ, এখন তা বেড়ে ৫৫০ শতাংশ হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ইটখোলার আকার বাড়াতে দখল হয়ে গেছে জৈনকাঠির সৈয়দ মহসীন, সৈয়দ মকসুদ, সৈয়দ হানিফ, দুলাল হাওলাদার, আলী আকবর, সুলতান খন্দকার, রহমান গাজী, জয়নাল আবেদীন মাস্টার, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন মাস্টার, শাহিদা বেগমসহ অনেকের জমি। ইটভাটায় চাপা পড়েছে কারও ২০ শতাংশ, কারও ৬০ শতাংশ। কারও ১২ কাঠা, কারও ১৭ কাঠা জমি। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চান না। জানতে চাইলে সুলতান মৃধা বলেন, ‘এসব কথা কোত্থেকে আসে? মানুষ আমাকে ভয় করে না, ভালোবাসে। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম, পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলাম। কখনো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ইটভাটায় তাঁর ১২ কাঠা জমি আছে। এর পরিবর্তে সুলতান মৃধা তাঁকে আরেক জায়গায় ৭ কাঠা জমি দিয়েছেন। আরেক ভুক্তভোগী পাভেল বলেন, ইটভাটার জন্য তাঁর ছোট মা শাহিদা বেগমের কাছ থেকে ১৭ কাঠা জমি নেন সুলতান। এর দাম ধরেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে জমি দখলে নেন। বাকি টাকার খবর নেই। সুলতান মৃধা বলেন, ‘কেউ তো কোনো দিন কমপ্লেইন করেনি। কমপ্লেইন থাকলে এত দিনে দুই-তিনটা মামলা হতো না? আপনি এলাকায় যাইয়া যদি প্রমাণ পান, তাহলে লেইখ্যা দেন।’ একবার পৌর এলাকা থেকে ইটভাটা সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় ইটভাটা সরাতে লোহালিয়ার শৌলা গ্রামের শামসুল হক, আবদুল খালেক ও শাহজাহানের কাছ থেকে দেড় একর করে সাড়ে চার একর জমি নেন সুলতান মৃধা। দাম ধরেন ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে শাহজাহানকে ৩ লাখ টাকা, আবদুল খালেককে ২ লাখ এবং শামসুল হককে ১ লাখ টাকা দিয়ে জমি দখলে নেন। বকেয়া টাকা আর দিচ্ছেন না। জানতে চাইলে সুলতান মৃধা বলেন, ‘শৌলার জমির দখল তারাই দিয়েছে। এসব জমির কাগজপত্র ঠিক নেই। আমি বলেছি, যদি কাগজপত্র ঠিক করে দিতে না পারো, আমার টাকা দিয়ে দেবা। আর তোমরা জমি নিতে চাইলে দিয়ে দেব।’
মাদ্রাসার ৫০ বছরের পুরোনো জমি দখল
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া মৌজায় ১৪ একর ২ শতাংশ জমির মালিক স্থানীয় জলিশা-জাটরা হাসানীয়া সিনিয়র দ্বিমুখী মাদ্রাসা। ১৯৬৩ সালে এই জমি মাদ্রাসার নামে কবলা করে দেয় কলাপাড়ার বাসিন্দা মোজাম্মেল হক মুন্সী গং। ৪৭ বছর পর ২০০৯ সালে জমির দখল হারায় মাদ্রাসা। সেখানেও আছে সুলতান মৃধার নাম। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এবং দলিলপত্রে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের গত আমলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী আসনের সাংসদ মাহবুবুর রহমান ওই জমির মধ্য থেকে ৮ একর জমির দলিল (নম্বর ৪৭৮০) করেন। ২০০৯ সালের ১০ জুলাই এই দলিল সম্পাদিত হয়। বাকি ৬ একরের মধ্যে কলাপাড়া ভূমি অফিসের তৎকালীন নাজির রফিকুল ইসলাম ১ একর ৬২ শতাংশ এবং টিয়াখালীর গাজী আব্বাস উদ্দিন ও প্রতিমন্ত্রীর ভাগনি জামাই আবু সালেহ ৪ একর ৩৬ শতাংশ জমি নেন। দলিলে চিনথাউ নামের এক ব্যক্তিকে মালিক দেখানো হয়। পরে আব্বাস উদ্দিনের কাছ থেকে ২ একর ৭০ শতাংশ জমির দলিল করেন সুলতান মৃধা। কাগজপত্রে দেখা যায়, এই জমির কিছু অংশ নিজের ও মেয়ে সামিমা নাসরিনের নামে রেখে বাকি অংশ শামীম হাসনাইন নামের এক ব্যক্তি এবং কিছু অংশ বরিশালের বিএনপি-সমর্থিত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে মো. কামরুল আহসানের নামে দলিল করেন। এই জমিতে তিনি প্রথমে নিজের নামে সাইনবোর্ড টাঙান। সম্প্রতি সাইনবোর্ড পাল্টিয়ে আবুল হোসেন রনির নাম দেওয়া হয়। জমি বেদখল হওয়ার পর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আলী আজম নুরুদ্দীন ও শিক্ষক আবুল কালাম মুন্সী পটুয়াখালীর সহকারী জজ আদালতে আবু সালেহ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত ২০১৫ সালে মাদ্রাসার পক্ষে রায় দিয়ে জমির ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। আবু সালেহরা জজকোর্টে আপিল করেন। আদালত ২০১৬ সালে তাঁদের আপিল খারিজ করে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখেন। এরপরও বিবাদীরা জমি জবরদখল করে চাষাবাদ করছেন। জানতে চাইলে ইটবাড়িয়া মৌজায় ২ একর ৭০ শতাংশ জমির এক-চতুর্থাংশ নিজের নামে থাকার কথা স্বীকার করেন সুলতান মৃধা। তাঁর দাবি, এই জমি তিনি কাগজপত্র অনুসারে কিনেছেন। মিউটেশনের পরে এই জমির দলিল হয়েছে। বিএনপির নেতা আহসান হাবিব কামালের ছেলের নামে জমির দলিল করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ করি বলে কি বিএনপিতে আমাদের বন্ধুবান্ধব-শুভাকাঙ্ক্ষী থাকতে পারে না?’
সওজের জায়গায় ফিলিং স্টেশন
পটুয়াখালীর রজপাড়ায় ছেলের নামে ‘পলাশ ফিলিং স্টেশন’ করছেন সুলতান মৃধা। এই ফিলিং স্টেশনের অধিকাংশ জমি সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বলে জানা গেছে। এর পাশেই আছে সুলতানের ৬২ শতাংশ জমি। এটি নিয়েছেন খুকুমণি নামে একজনের কাছ থেকে। জানতে চাইলে ফিলিং স্টেশনে সওজের কিছু জায়গায় থাকার কথা স্বীকার করেন সুলতান মৃধা। তবে তিনি দাবি করেন, সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁদের জায়গা ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন। এটি অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। পায়রা বন্দর এলাকায়ও সুলতান মৃধা জমি নিয়েছেন। বন্দরের সীমানা লাগোয়া একটি সাইনবোর্ডে সুলতান আহমেদ মৃধাসহ আটজনের নাম আছে। এটি টিয়াখালী মৌজায়। এই সাইনবোর্ডে জমির পরিমাণ ১০ একর বলে উল্লেখ আছে। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, উপজেলার ইটবাড়িয়া মৌজায় তাদের ৫১ একর ৬২ শতাংশ এবং টিয়াখালী মৌজায় ৩০ একর ৯ শতাংশ জমি আছে। পায়রা বন্দরের পাশে টিয়াখালী মৌজায় ঠিকাদার মহিউদ্দিন ও সুলতান মৃধাদের দখলে পাউবোর জমিও আছে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের রজপাড়ায়ও সুলতান মৃধার জমি আছে। সেখানে একটি সাইনবোর্ডে সুলতানসহ তিনজনের নামে ৮ একর জমির তথ্য রয়েছে। এতে রজপাড়ার শাহজাহান মিয়ারও ১৫৬ শতাংশ জমি আছে। গত বছর তিনি এই জমি বিক্রি করেন। বর্তমানে এই জমির বাজারদর দেড় কোটি টাকার ওপরে। জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে শাহজাহান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ও তো (সুলতান মৃধা) একটা ডাকাত। আমাকে মাত্র ১৫ লাখ টাকা দিয়ে জমির দলিল নিয়ে গেছে। আমি তাঁকে জমির জমাখারিজ পর্যন্ত করে দিয়েছি। এখন আর তাঁকে পাই না।’ অবশ্য সুলতার মৃধার দাবি, শাহজাহান মিয়া আর ২ লাখ টাকা পাবেন। তাঁর জমি কম আছে। জমি বুঝিয়ে দিলে টাকা দিয়ে দেবেন।
কাঠপট্টিতে সরকারি জমি দখল
পটুয়াখালী শহরের পুরান বাজারের কাঠপট্টিতে সরকারি জমি দখল করে একটি টিনের ঘর করেছেন সুলতান মৃধা। এটি দেখভাল করেন আবুল বাশার নামে তাঁর কাছের এক ব্যক্তি। এই টিনের ঘরের পাশে পৌরসভার ড্রেন, তার পাশে জিন্নাত আলী গাজী জামে মসজিদ। গত বছর মসজিদের সীমানায় সুলতান মৃধার নামে সাইনবোর্ড টাঙানো হলে এলাকায় প্রতিক্রিয়া হয়। পরে জেলা প্রশাসন সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করে। সুলতান মৃধা বলেন, ‘ওইটা আমার নলেজে নেই। সাইনবোর্ড কে দিয়েছে, তা-ও আমি জানি না।’ স্বামীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ লুৎফুন নেছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতি করতে গেলে পেছনে শত্রু থাকে। আমার সাহেব ভালো মানুষ। নেত্রী আমাকে এমপি করেছেন, মানুষ খুশি হয়েছে। আমি তার মর্যাদা রাখছি।’ অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘যাঁর বিরুদ্ধে (সুলতান মৃধা) দুর্নীতির সাতটি মামলা আছে। সব মামলায় চার্জশিটও হয়েছে। যিনি বিএনপি করেছেন, তাঁর বউকে কেন, কী কারণে নেত্রী এমপি বানাইছেন আমি জানি না। তাঁকে কেউ জীবনে কোনো দিন রাস্তায় মিছিল-মিটিংয়ে দেখেছে?’

No comments

Powered by Blogger.