ফিরে আসারা কথা বলেন না কেন?

নিখোঁজ হওয়াদের মধ্যে ভাগ্যবান আরো দুইজন ফিরে এসেছেন। সেই ভাগ্যবান উৎপল দাস আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বের দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিলেন। এভাবে অনেকে ফিরে এলেও এখনো কয়েক শ’ মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। যারা একে একে ফিরছেন তাদের কেউ নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে মুখ খুলতে আগ্রহী নন। কিভাবে নিখোঁজ হলেন, এ দীর্ঘ সময় তারা কোথায় ছিলেন, কিভাবে ছিলেন- এসব তারা বলতে নারাজ। যে কারণে নিখোঁজ রহস্য দিন দিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় খোঁজ পাওয়া যায় উৎপল দাসকে। উৎপল দাস দুই মাস ১০ দিন নিখোঁজ ছিলেন। গত ১০ অক্টোবর অফিস থেকে বের হওয়ার পরে নিখোঁজ হন উৎপল। এ দিকে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোবাশ্বার হাসান সিজার গত ২২ ডিসেম্বর রাতে ফিরে এসেছেন। গভীর রাতে তিনি বাসায় ফেরেন। গত ৭ নভেম্বর কর্মস্থল থেকে বনশ্রীর বাসায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন সিজার। তিন মাসে খোদ রাজধানীতেই নিখোঁজ হয়েছেন ১৩ জন। যাদের মধ্যে মোবাশ্বার ও উৎপলসহ ফিরে এসেছেন ৯ জন। বাকি চারজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এ ৯ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আবার কয়েকজনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। রাজধানী ধানমন্ডি এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন ভিয়েতনামের বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান (৭০)। এ ঘটনায় তার মেয়ে সামিহা জামান বাদি হয়ে পরদিন ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি (জিডি নম্বর-২১৩) করেন। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় মারুফ জামানের গাড়িটি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ৪ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় ধানমন্ডির ৯/এ রোডের ৮৯ নম্বর বাড়ির ২/এ নম্বর ফ্যাট থেকে মারুফ জামান বিমানবন্দরের উদ্দেশে বের হয়ে যান। তার মেয়ে সামিহা জামান বিদেশ থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বিমানবন্দরে সামিহা জামান পৌঁছলেও তার বাবা তাকে রিসিভ করার জন্য সেখানে যাননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে মারুফ জামানের কোনো অবস্থান নিশ্চিত না করতে পেরে মঙ্গলবার সকালে থানায় জিডি করা হয়।পারিবারিক সূত্র জানায়, ৪ ডিসেম্বর রাতে মারুফ জামান তার বাসায় ফোন দিয়ে তার রুমে থাকা ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কাছে দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। ওই দিন রাত ২টায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার বাসায় গিয়ে ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। অন্য যারা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন তারা হলেন, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও এ বি এন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ সাদাত আহমেদ, কল্যাণ পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আমিনুর রহমান এবং কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইশরাক। ফিরে এসেছেন বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা আসিত ঘোষ অসিত, বেলারুশের অনারারি কনস্যুলার অনিরুদ্ধ কুমার রায়, দক্ষিণ বনশ্রীর নকিয়া-সিমেন্সের সাবেক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আসাদ, এভেনটিস-স্যানোফির ফার্মাসিস্ট জামাল রহমান, শাজাহানপুর থেকে ফল ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন ও গুলশানের প্রকাশক তানভীর ইয়াসিন করিম।
বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা আসিত ঘোষ অসিতকে গ্রেফতার দেখিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর মধ্যে মিঠুনের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। আর তার সাথে ষড়যন্ত্রে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় অসিতকে। পল্টন এলাকা থেকে মিঠুন চৌধুরী ও সেগুনবাগিচা থেকে অসিত চৌধুরীকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, গত ৭ নভেম্বর কদমতলী থানায় একটি জিডি হয়। সেই জিডির তদন্তে নেমে ডিবি অসিতের অপরাধের ব্যাপারে তথ্য পায়। তবে মিঠুন চৌধুরীর স্ত্রী সুমনা চৌধুরীর দাবি, সংখ্যালঘুদের অধিকার রায় কাজ করেন তার স্বামী। হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে তিনি লেখালেখি করতেন। কিন্তু তিনি কোনো ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন না। ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করে পোস্ট দেয়ার কারণে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও ধারণা সুমনার। গত ৮ নভেম্বর গুলশান-২ নম্বরের ৫১ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে কনকর্ড প্যানোরমা অ্যাপার্টমেন্টের ১০১ নম্বর ফ্যাট থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায় করিম ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি পুস্তক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকার তানভীর ইয়াসিন করিমকে। এ ঘটনায় তার আত্মীয় হুমায়ন কবীর বাদি হয়ে গুলশান থানায় একটি জিডি করেন। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়। তার বিরুদ্ধে গত ১৫ আগস্ট পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে এক জঙ্গির আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনায় অর্থ জোগানদাতার অভিযোগ আনা হয়েছে। তানভীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শোক দিবস কর্মসূচিতে হামলা চেষ্টার পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত ২৬ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর কাকরাইল মোড় থেকে আব্দুলাহ আল মামুন নামে এক ব্যক্তি নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় নিখোঁজের ভগ্নিপতি ডা: সাইফুল ইসলাম রমনা থানায় একটি জিডি করেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘটনার সময় অজ্ঞাত ১০-১২ জন আব্দুল্লাহকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকেই এর আগেও ফিরে এসেছেন। গত ১১ জুন ভোর রাতে বাড়ি ফেরেন লক্ষ্মীপুর থেকে হারিয়ে যাওয়া রাকিবুল হাসান রকি। কে বা কারা তাকে গাড়িতে করে এনে শহরের বাগবাড়ি এলাকায় ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে এক রিকশাচালক তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর শহরের পুরনো আদালত রোড এলাকা থেকে রাত ১০টায় সাদা মাইক্রোবাসে তাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় ডা: ইকবাল মাহমুদকে। সেই থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। গত ৩১ মে রাতে কে বা কারা তাকে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার নতুন গরুহাটা এলাকায় রেখে যায়। সেখান থেকে তিনি বাসায় ফিরে যান। কে বা কারা তাকে অপহরণ করেছিল তা জানা যায়নি। এর আগে গত ৩ মার্চ ফিরে এসেছেন বিএনপি নেতা হুমাম কাদের চৌধুরী। ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর আদালত পাড়া থেকে তুলে নেয়া হয় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরীকে। ৩ মার্চ ভোরে তিনি ফিরে আসেন। কে বা কারা তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেলে সেখান থেকে তিনি বাসায় ফেরেন। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিলের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ঢাকার উদ্দেশে আসার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের দেলপাড়া এলাকার ভূইয়া ফিলিং স্টেশন এলাকা থেকে অপহৃত হন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক। ওই বছরের ১৮ এপ্রিল মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় কে বা কারা তাকে ছেড়ে দিয়ে যায়। এ ঘটনায় আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা করলেও কে বা কারা আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করেছিল সে সম্পর্কে কোনো রহস্য আজো উদঘাটন হয়নি। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ একদল অচেনা লোক উত্তরার ভাড়া বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বিএনপির তৎকালীন মুখপাত্র সালাহ উদ্দিনকে। প্রায় দুই মাস পরে ভারতের শিলং থেকে উদ্ধার করা হয় সালাহ উদ্দিনকে। কে বা কারা সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই রহস্য আজো বের হয়নি। গত বছরের ১৬ মার্চ নিখোঁজ হন আইটি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় তিনি তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সহায়তা করে আসছিলেন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পরে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। কয়েক দিন পরে বিমানবন্দর এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়। নিখোঁজ এ ব্যক্তিরা ফিরে এলেও ঘটনার নেপথ্য রহস্য অজানাই থেকে যাচ্ছে। যারা ফিরে এসেছেন তারা বা তাদের পরিবার এ নিয়ে আর কোনো কথাই বলতে চান না। নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায় ছিলেন, কিভাবে ছিলেন, কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেসব বিষয়ে কথা বলতে তারা একেবারেই নারাজ। ফলে দিন দিন এ নিখোঁজ রহস্য আরো রহস্যাবৃত হয়ে পড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.