শিশুদের বন্ধু হন

একদিন ক্লাসে শিক্ষিকা সবাইকে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বিষয়ে লিখতে বললেন। লেখার নির্ধারিত সময় শেষ হলে তিনি সবার খাতা নিলেন এবং সেদিনের মতো ক্লাস শেষ করে চলে গেলেন। বাসায় এসে তিনি সব খাতা পড়তে শুরু করলেন। একটি খাতায় তার চোখ আটকে গেল। লেখাগুলো পড়ে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। পাশে থাকা তার স্বামী বিষয়টি লক্ষ করে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? শিক্ষিকা কথা না বলে খাতাটি এগিয়ে দিলেন।
তাতে লেখা : ‘আমার জীবনের লক্ষ্য হল টেলিভিশন হওয়া। কারণ আমাদের বাসায় যে টেলিভিশনটি আছে, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবাই এর সামনে গিয়ে বসে আর গভীর মনোযোগ গিয়ে টিভি দেখে। অনেক সময় খাওয়া-দাওয়ার কথাও মনে থাকে না। টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠান দেখে তারা হাসি-আনন্দে ফেটে পড়ে। দিনের বিভিন্ন সময় টিভির অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে নিজেরা আলোচনা করে। যদি টিভিটি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা ঠিক করার জন্য সবাই উঠেপড়ে লাগে। আমি চাই টেলিভিশনের মতোই আমাকে সবাই গুরুত্ব দেবে। আমার প্রতি মনোযোগী হবে। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে সবাই আমার যত্ন নেবে। এ কারণেই আমি টেলিভিশন হতে চাই।’ পড়া শেষে স্বামী বলল, ছেলেটি কত দুর্ভাগা! নিশ্চয়ই তার বাবা-মা ও পরিবারের সবাই অনেক ব্যস্ত। তাকে কেউ সময় দেয় না। তখন শিক্ষিকা বললেন, তুমি মনে হয় খেয়াল করোনি যে এসব লিখেছে সে আমাদেরই ছেলে! এটি একটি গল্প হলেও এর ভেতর দিয়ে একটি ছেলের গভীর হতাশাবোধ, হাহাকার ও নিঃসঙ্গতার চিত্র ফুটে উঠেছে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে রয়েছে এর যোগসূত্র। আজকাল অনেক পরিবারেই বাবা-মা খুব ব্যস্ত থাকেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। বড়দের বাইরে যাওয়ার এবং নিজের মতো করে সময় কাটানোর সুযোগ থাকে; কিন্তু শিশুদের তেমনটি থাকে না। আবার এখন মাঠের সংখ্যা কমে যাওয়ায় শিশুরা আগের মতো খেলাধুলাও করতে পারছে না।
এ কারণে তাদের বাসায় অবসরে অলস সময় কাটানো, টিভি দেখা, কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকা ও মোবাইলে গেম খেলাটাই হয়ে দাঁড়ায় মুখ্য বিষয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক সুস্থতার স্বার্থে তাদের বন্ধু হওয়া, তাদের জন্য পরিবারের সময় দেয়া জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকা খুললেই দেখা যায় শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, পরকীয়ার বলি হওয়া, বখাটেদের উৎপাতে কিশোরীর আত্মহত্যা ইত্যাদি ঘটনার খবর। এসব উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চার বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা এ জাতির জন্য লজ্জাজনক। একটি শিশুর প্রতি যদি এমন আচরণ করা হয়, তাহলে এ জাতির ভবিষ্যৎ কী? এর একটি সমাধান হতে পারে শিশুদের বন্ধু বানানো। তাদের বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়া যেতে পারে ভালো ও সৎ মানুষের সঙ্গে। রাষ্ট্রকে হতে হবে শিশুবান্ধব, রাষ্ট্র তাদের জন্য নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা করবে, উন্মুক্ত ও সবুজ মাঠে খেলাধুলা করার অবারিত সুযোগ তৈরি করে দেবে এবং নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও শিশুবিকাশ কার্যক্রম চালু করবে। সেই সঙ্গে সব ধরনের শিশু নির্যাতনের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
মু. তৌহিদুল ইসলাম : শিশু সংগঠক; কাউন্সিলর, বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ

No comments

Powered by Blogger.