কোন্দলের মাশুল দিতে হতে পারে আ’লীগ-বিএনপিকে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ (সদর ও রাজনগর) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকাবাসীর দোয়া ও আশীর্বাদ চেয়ে প্রচারে নেমে পড়েছেন। পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপরতা চালাচ্ছেন সমর্থকরা। বিভিন্ন দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে টানানো শুরু হয়েছে ব্যানার ও ফেস্টুন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়াও জাতীয় পার্টি, খেলাফত মজলিস, জামায়াত, কমিউনিস্ট পার্টিসহ ২০ দলীয় ও ১৪ দলীয় জোটের সম্ভাব্য ডজন খানেক প্রার্থী নানা কায়দায় তাদের আগ্রহের বিষয়টি জানান দিচ্ছেন। তবে মনোনয়ন যারাই পাক না কেন দলীয় কোন্দলই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর সহধর্মিণী সৈয়দা সায়রা মহসিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ, দলের জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ও চেম্বার সভাপতি মো. কামাল হোসেন, সাবেক ব্রিটিশ কাউন্সিলর এমএ রহিম (সিআইপি) ও মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালিক তরফদার সোয়েব। মৌলভীবাজার-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসিন বলেন, দল থেকে মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করব। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, সাবেক ব্রিটিশ কাউন্সিলর এমএ রহিম বলেন, ২০০৬ সাল থেকে একাধিক জাতীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিরত থেকেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নপূরণ এবং সোনার বাংলা গড়তে আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করব। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপাধ্যক্ষ আবদুস শহিদ বলেন, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কাজ শুরু করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলীয় বোর্ড বসে পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এর আগে যে কেউ নিজেকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচারণা চালাতে পারেন।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন- সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান। জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের এখনও অনেক সময় বাকি। সময় এলে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে প্রস্তুতি নেয়া হবে। জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সৈয়দ শাহাবউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল হকের নাম। এ ছাড়া জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মাওলানা জামিল আহমদ আনসারী ও শরিফ খালেদ সাইফুল্লাহ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকায় তৎপর। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহমদ বিলাল কেন্দ্রের অনুমতিসাপেক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থানীয় নেতারা দলের মধ্যে বিদ্যমান কোন্দলকে চিন্তার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও দলীয় কোন্দল দলের প্রার্থীর বিজয় ঠেকিয়ে দিতে পারে। জেলা বিএনপির সভাপতি ও সম্পাদকের অবস্থান দুই মেরুতে। তাদের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত মৌলভীবাজার বিএনপি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজানকে সরকারের দালাল আখ্যা দিয়ে রাজপথে মিছিলও হয়েছে। বিভক্তির কারণে মৌলভীবাজারে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। এটা যদি চলতে থাকে তাহলে তা আগামী নির্বাচনের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের। দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় বিএনপির সম্মেলনের আগে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির দু’গ্রুপের সমন্বয়ে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকের নাম উল্লেখ করে কমিটি অনুমোদন দেয় তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ওই কমিটির সভাপতি হন সাবেক অর্থমন্ত্রী, প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের ছেলে এম নাসের রহমান। অপর গ্রুপ থেকে খালেদা রব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সভাপতি বলয়ের আবদুুল মুকিতকে করা হয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে একাধিকবার কেন্দ্রীয় নেতারা মৌলভীবাজার সফর করলেও পরস্পরবিরোধী অবস্থানের হেরফের হয়নি। জেলা বিএনপির গ্রুপিংকে কেন্দ্র করে যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনও বিভক্ত। জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সভাপতি বলয়ের নেতাকর্মীরা আমার জনপ্রিয়তা সহ্য করতে না পেরে আমাকে সরকারের দালাল আখ্যায়িত করে রাজপথে মিছিল করেছে। এরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমি তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে এ পর্যন্ত এসেছি। আমি চাই, সব ভেদাভেদ ভুলে একত্রিত হয়ে কাজ করতে। সভাপতি সেটা চান না। তিনি বলেন, যারা আমাকে দালাল বলছে তারা সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে খালেদা জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এদিকে আওয়ামী লীগেও একই হাল। এই আসনে উপাধ্যক্ষ আবদুস শহিদ ও সায়রা মহসিনকে ঘিরে দুটি বলয় গড়ে উঠেছে। আগস্ট মাসে দুটি শোকের অনুষ্ঠান পালনকে কেন্দ্র করে বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর আগে ভোটারদের কাছে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব প্রকাশ না পেলেও শোকের অনুষ্ঠানকে ঘিরে আলাদা অনুষ্ঠান করার মধ্য দিয়ে বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শেষ পর্যন্ত আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৃণমূল নেতাকর্মীদের। সূত্র বলছে, প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর স্ত্রী সৈয়দা সায়রা মহসিন, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ফিরোজ ও সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি মসুদ আহমদকে ঘিরে এ বলয় কাজ করছে। অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক চিফ হুইপ মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহিদের নেতৃত্বাধীন বলয়ে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা। তবে দলীয় অনুষ্ঠানে সায়রা মহসিনসহ তার বলয়ের নেতাকর্মীদের তেমন দেখা যায় না। দলের কোন্দল নিয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপাধ্যক্ষ আবদুস শহিদ বলেন, আমি এবং জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সব সময় দলীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে আসছি। এসব অনুষ্ঠানে অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত হন আবার কেউ কেউ আসছেন না। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যেখানে উপস্থিত সেখানে গুটি কয়েকের অনুপস্থিতিকে গ্রুপিং বলা যায় না। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে জেলা সম্মেলন করার জন্য ইতিমধ্যে সদর উপজেলা ও পৌর কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। এ বছরের শেষদিকে জেলা সম্মেলন করে নতুন আয়োজনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবেন বলে দলীয় একাধিক সূত্র জানায়। এ বিষয়ে আলাপকালে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সৈয়দ শাহাব উদ্দিন বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এরশাদের হাতকে শক্তিশালী করতে আমরা জেলা সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করব। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন বলেন, এখনও আমাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি তবে শিগগির বসে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। জেলা জামায়াতের আমীর আবদুল মান্নান বলেন, দলীয়ভাবে মৌলভীবাজার-৩ আসনে নির্বাচন করার কোনো পরিকল্পনা নেই এখন পর্যন্ত। জেলা খেলাফত মজলিসের সভাপতি অধ্যাপক আবদুস সবুর বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে প্রার্থী নির্ধারণ করে নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছি। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আমাদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

No comments

Powered by Blogger.