মিরপুরে তরুণকে ডেকে এনে কুপিয়ে হত্যা

রাজধানীর মিরপুরের উত্তর পীরেরবাগে মঙ্গলবার এক তরুণকে হত্যা করা হয়েছে। কবির হোসেন (২১) নামের ওই তরুণ পেশায় গার্মেন্ট কর্মী। সকালে মোবাইল ফোনে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে শরীরে বিভিন্ন অংশে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে ও পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। সেই দৃশ্য ধরা পড়ে এক বাড়ির ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায়। ভিডিও ফুটেজে তিন তরুণকে এ অপকর্মে দেখা গেছে। স্থানীয় সূত্র বলছে, ওই তিন তরুণ হলেন- বাপ্পী, মুন্না ও রাজু। বাপ্পী ও মুন্না দুই ভাই। দু’দিন আগে কবিরের নেতৃত্বে বাপ্পী ও তার বাবা ফজলুল হকের ওপর হামলা হয়েছিল। এরপর বাপ্পীকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রতিশোধ নিতে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসে বাপ্পী। এরপর পরিকল্পিতভাবে কবিরকে খুন করা হয়। তিন মিনিটে শেষ হয় কিলিং মিশন। স্থানীয় সূত্র বলছে, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে চার মাস ধরে উত্তর পীরেরবাগে তরুণদের দুটি গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। এর জের ধরে মাঝেমধ্যেই দুই গ্রুপের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ধীরে ধীরে দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। এর জেরেই কবিরের নেতৃত্বে বাপ্পী ও তার বাবার ওপর হামলা হয়। কবিরকে হত্যার পর বাপ্পী-মুন্নার বাবা ফজলুল হককে আটক করেছে পুলিশ। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাকে থানায় আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে উত্তর পীরেরবাগের ৩৬৩/৮/১ নম্বর বাসার সামনে। ওই বাড়ির সামনের দিকের একটি সিসি ক্যামেরায় খুনের দৃশ্যটি ধরা পড়েছে। ওই বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নজমুল নেওয়াজ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে সকালে। আমরা কোনো কিছু টের পাইনি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, এক তরুণের ওপর তিন তরুণ হামলা চালাচ্ছে। একজন লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে আর অন্য দু’জন ছুরিকাঘাত করছে। পরে তারা পালিয়ে যায়। তবে আমি তাদের কাউকে চিনি না। পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে ৬টা ৯ মিনিট থেকে ৬টা ১২ মিনিট পর্যন্ত কবিরের ওপর হামলা চলে। ছুরি দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে একের পর এক জখম করা হয়। এরপর হামলাকারী তিন তরুণ পালিয়ে যায়। কবিরের বড় ভাই মাইনুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আকাশ নামে স্থানীয় এক তরুণ মোবাইল ফোনে কবিরকে ডেকে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর খবর পাই কবিরের ওপর হামলা হয়েছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি, রাস্তায় কবির পড়ে আছে। তখনও সে বেঁচে ছিল। জিজ্ঞাসা করি, তোর এই অবস্থা করেছে কে। ওই সময় কবির জানায়, বাপ্পী, মুন্না, রাজু, সোহেল ও আকাশ তার ওপর হামলা করেছে। সে আর কিছু বলতে পারেনি। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
মিরপুর থানার ওসি নজরুল ইসলাম মঙ্গলবার দুপুরে যুগান্তরকে বলেন, এখানে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব আছে এমন ঘটনা আমাদের জানা নেই। বাপ্পী ও তার বাবার ওপর দু’দিন আগে কবিরের নেতৃত্বে হামলা হয়েছিল। ওই হামলার প্রতিশোধ নিতেই কবিরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। পরিবার জানায়, কবিরের গ্রামের বাড়ি ভোলা সদরে। তার বাবা মো. হানিফ পেশায় কৃষক। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে তৃতীয়। কবিরের বাবা ভোলাতেই থাকেন। পরিবারের অন্যরা উত্তর পীরেরবাগের ৩৬৮ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকেন। যে কারণে খুন : স্থানীয়রা জানান, কবির ও তার বন্ধুরা এক সময় মুন্নার সহযোগী ছিল। মুন্না এলাকার স্থানীয় হওয়ার কারণে অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করত। এক সময় মুন্না নিজেকে সিনিয়র দাবি করে। এ নিয়ে কবিরের সঙ্গে চার মাস আগে কথা কাটাকাটি হয়। ওই সময় কবিরের নেতৃত্বে আলাদা গ্রুপ তৈরি হয়। বিভিন্ন সময় দুটি গ্রুপের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। রোববার সকালে কবির ও তার তিন বন্ধু মিরপুরের কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরছিল। এ সময় মুন্না তাকে উদ্দেশ করে বলে, ‘তুই দাঁত কিটমিট করছিস কেন?’ কবির পাল্টা জবাবে বলে, ‘দাঁত কিটমিট করলে তুই কী করবি?’এর মধ্যেই মুন্নার বড় ভাই বাপ্পী চলে আসে। তখন মুন্না ও তার সহযোগীরা কবির ও তার তিন বন্ধু লোকমান, রুবেল ও শাকিলকে মারধর করে। এ ঘটনার পর কবিরের নেতৃত্বে বাপ্পী ও তার বাবা ফজলুল হকের ওপর হামলা চালানো হয়। পুলিশ জানায়, বাপ্পীর শরীরে ২৬টি সেলাই দেয়া হয়। তার বাবা ফজলুল হকের শরীরেও ৬টি সেলাই লাগে। মূলত এর প্রতিশোধ নিতেই পরিকল্পিতভাবে কবিরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কবিরের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মিরপুর থানার এসআই নাসির উদ্দিন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, পেটের ডান পাশে কাটার জখম, বুকে দুটি রক্তাক্ত জখম, পিঠের ডান পাশে দুটি কাটা রক্তাক্ত জখম, পিঠে দুটি কাটা রক্তাক্ত জখম, বাম হাতের কনুইর নিচে গভীর কাটা রক্তাক্ত জখম, কব্জির ওপরে গভীর কাটা জখম, ডান হাতের কনুইর নিচে রক্তাক্ত জখম, দুই হাতে দুটি রক্তাক্ত জখম, ডান পায়ের হাঁটুতে কাটা রক্তাক্ত জখম এবং বাম কোমরের ওপরে দুটি কাটা রক্তাক্ত জখম রয়েছে। দুই গ্যাংয়ে ২০ সদস্য : স্থানীয় সূত্র বলছে, আধিপত্য বিস্তার ও এলাকার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে উত্তর পীরেরবাগে দুটি গ্যাং গড়ে উঠেছে। একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্বে ছিল নিহত কবির। অপর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে মুন্না। দুটি গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। এই গ্যাংয়ে স্কুল পড়–য়া কিশোরও রয়েছে। চার মাস আগে আলাদা কোনো গ্যাং ছিল না। আধিপত্য বিস্তার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে চার মাস আগে দুটি গ্যাং তৈরি হয়। মুন্নার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গ্যাংয়ের সদস্যরা হল মুন্না, রাজু, রিপন, বিপ্লব, মানিক, জয়, সোহেল, আকাশ ও শাহীন। কবিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গ্যাংয়ের সদস্যরা হল- রকিব, সম্রাট, লোকমান, শাকিল, আকাশ, আল-আমিন, হৃদয়, নয়ন, ইমন ও রাহাত।

No comments

Powered by Blogger.