ত্রাণ না পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা

নওগাঁর মান্দা উপজেলার দারিয়াপুর গ্রাম। পাশের গ্রাম থেকে গলা পানি মাড়িয়ে এসেছেন ৫৫ বছরের বৃদ্ধা আরতি রানী। লোকমুখে তিনি শুনেছিলেন ত্রাণ বিতরণের কথা। কিন্তু এখানে এসে তার কপালে জোটেনি কোনো সাহায্য। খালি হাতে ফেরার সময় সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। বললেন, আত্রাই নদীর বানে ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তার ধারে। পরিবারের আয় উপার্জনের কেউ নেই। ঘরে খাবারের জোগাড়ও নেই। যা ছিল কয়েক দিনে তাও শেষ। তাই দু’দিন ধরে পেটে ভাত যায়নি। কোনো বেলা পাউরুটি আবার কোনো বেলা চিড়া খেয়ে আছি। রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় ওই ঘটনার সময় আরতি রানী আরও জানান, একদিন আগেই স্থানীয় এমপি ও পাটমন্ত্রী ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক ত্রাণ বিতরণ করে গেছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষই ওই সাহায্য পাননি। এ নিয়ে হট্টগোল হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। এই জেলার বানভাসি মানুষ এখন খাবার ও চিকিৎসার অভাবে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে শত শত বানভানি আশ্রয় নিলেও বিপদ তাদের পিছু ছাড়েনি। প্রসাদপুর ইউনিয়নের দারিয়াপুর গ্রামের সড়কের দুই পাশে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশ’ বানভাসি পরিবার। এখন পানি কমছে। কিন্তু বেড়েছে পানিবাহিত রোগবালাই। এজন্য মেডিকেল টিম নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সরেজমিন দেখা যায়, ডায়রিয়ার সমস্যা নিয়ে অন্তত পাঁচজন সকাল থেকে বসে আছেন মেডিকেল টিমের ব্যানার টানানো স্থানে। তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ আছেন। তারা জানান, তিন দিন আগে ডাক্তার (স্বাস্থ্যকর্মী) এসেছিলেন। এখন ডায়রিয়া প্রায় সবারই শুরু হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারের খোঁজ নেই। শুধু ব্যানার টানিয়েই চলে গেছেন তারা। ওই এলাকার হাফিজউদ্দিন মৃধা জানান, এক সপ্তাহ ধরে বন্যায় মানুষ দিশেহারা। থাকার জায়গা নেই। খাবার নেই। এ অবস্থায় বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সবাই শুধু মুখে মুখে সাহায্যের কথা বলছে। বাস্তবে কোনো কিছুই নেই। আর রাস্তায় ঠাঁই নেয়াদের আপাতত থাকার ছাউনির জন্য প্লাস্টিক দিয়েছে একটি এনজিও। কিন্তু এর বাইরে কিছু পাইনি। মন্ত্রী ত্রাণ বিতরণ করলেও পেয়েছেন দলীয় সমর্থকরা। প্রকৃত নিঃস্বরা পায়নি। উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের রেবা আখতার দাখিল মাদ্রাসা বন্ধ করে বানভাসি কয়েকশ’ নারী-পুরুষকে রাখা হয়েছে। এখানে ঠাঁই নেয়া কয়েকজন জানান, তিন দিন ধরে তারা ভাত খেতে পাননি। সকালে পাউরুটি দেয়া হয়। দুপুরে খিচুড়ি। রাতে চিড়া। এসব খেয়ে তো আর দিন চলে না। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা তীব্র খাবার সংকটে পড়েছেন। ওই মাদ্রাসার শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, প্রায় আটশ’ মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। শোয়ার জায়গা নেই। খাবার পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থাও নাজুক। স্থানীয় যারা বিত্তবান আছেন, তারাই কেউ সকালে, কেউ দুপুরে আবার কেউ রাতের খাবারের খরচ দিচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক বলেন, যেভাবে বন্যা হচ্ছে, তা এখন জাতীয় দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। কাজেই দলীয় লোক দেখে ত্রাণ বিতরণের অভিযোগ থাকার কথা নয়। দল ও মতের ঊর্ধ্বে থেকে সবাইকে এই বিপদে সাহায্য করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ অব্যাহত আছে। নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. রওশন আরা যুগান্তরকে জানান, বন্যাদুর্গতদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১২৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। প্রতিটি টিমে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা-কর্মীরা কাজ করছেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই টিম খাবার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করছে বলেও দাবি করেন তিনি। এদিকে ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি নওগাঁর বন্যার্ত মানুষের। দুর্গত এলাকার প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন। ইকরতারা নামক স্থানে ছোট যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে সদর উপজেলার তিলকপুর, বোয়ালিয়া ইউনিয়ন, নওগাঁ পৌরসভার পার-নওগাঁ, সুলতানপুর এলাকা, পার্শ্ববর্তী বগুড়ার আদমদিঘি উপজেলার ছাতিয়ান গ্রাম, সান্তাহার এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁর মোট ১০ উপজেলায় ৬৬ ইউনিয়নের ৫১৬টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। ৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রায় ৬৮ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। জেলায় প্রায় ৮১ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে এবং ২৬ হাজার বাড়িঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় মোট ১২ জন লোক নিখোঁজ রয়েছে। দুই শিশুসহ নিহত হয়েছে তিনজন। জেলা প্রশাসক ড. মো. আমিনুর রহমান জানান, জেলায় বন্যার্তদের ত্রাণ সাহায্য অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, রোববার পর্যন্ত জেলার ৯টি উপজেলায় ৩৪৭ মেট্রিক টন চাল এবং ১৫ লাখ ২২ হাজার নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.