উজানের ঢল ও বর্ষণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বর্ষণে নীলফামারী, খুলনা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিতে হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষকের রোপা আমন-আউশ ধান ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। নওগাঁর নিয়ামতপুরে ক্ষুদ্র পানিসম্পদ প্রকল্পের বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। ফের বন্যায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী ও ডিমলা
নীলফামারীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া নিন্ম আয়ের লোকজন। তিন দিন ধরে নীলফামারীতে চলছে অবিরাম বৃষ্টিপাত। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার (বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৪০) নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া অবিরাম বর্ষণে চারালকাটা, ধাইজান, বুড়িতিস্তা, খড়খড়িয়া, ঘাঘট, ধলেশ্বরী, বুড়িখোড়াসহ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৪টি নদীর পানি বেড়েছে। ফলে নদীগুলোর তীরবর্তী গ্রামগুলো হাঁটুপানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে বেশ কিছু এলাকার আমন ক্ষেত।
নিয়ামতপুর (নওগাঁ)
নিয়ামতপুর উপজেলার বহড়াঘাটির খাড়িতে এলজিইডি নির্মিত ক্ষুদ্র পানি প্রকল্পের বাঁধের ওপর দিয়ে অতিরিক্ত বর্ষণের পানি চলে যাচ্ছে নিচের দিকে। এতে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে নয়নাভিরাম জলপ্রপাতের।
খুলনা
ডুমুরিয়া উপজেলার সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অতিবৃষ্টি এবং ভদ্রা নদীর উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে গ্রামগুলো। বদ্ধ হয়ে থাকা পানির কারণে ওই সব গ্রামের সব বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় পানি আটকে রয়েছে। এসব গ্রামের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। গাছপালার পাতায় লালচে আবরণ পড়তে শুরু করেছে। এলাকাবাসী জানায়, ডুমুরিয়া উপজেলার কাঞ্চনপুর, ঘোষড়া, বাদুড়িয়া, কাকুড়পাড়া, বেতাগ্রাম, আটলিয়া, সুভাশুনির ৭টি গ্রাম অতি বৃষ্টি, ভদ্রা নদীর উজানের পানি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ
জেলার সবকটি নদীর পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর পানি শহরের ষোলঘর পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, শাল্লা ও দোয়ারাবাজার এবং সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার পাহাড়ি নদী জাদুকাটা, চেলা, রক্তি, বৌলাইসহ হাওরের পানিও কয়েক ফুট বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে জেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন শুক্রবার বিকাল ৫টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। একই সঙ্গে উপজেলাগুলোতেও সভা করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও
মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ঠাকুরগাঁওয়ে টানা দু’দিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শুক্রবার সারাদিন প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় ঘরবন্দি কাটায় শহর কী গ্রামের মানুষ। টানা বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। নদীনালা, খাল-বিল বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে।
বেসরকারি সংস্থা সিডিএ জানায়, শ্রাবণের শেষের দিকে এ রকম ভারি বৃষ্টি হবে তা ভাবায় যায়নি। এ বৃষ্টিতে কাঁচা ঘরবাড়ির এখনও পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে মৌসুমি শাকসবজি ও মরিচ ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া নিচু জমির আমন চারা তলিয়ে গেছে।
আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
আখাউড়া উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কৃষকের রোপা আমন ও আউশ ধানের ফসলি জমি, বসতঘরসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া পানিতে ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়ন, মনিয়ন্দ, মোগড়া ও ধরখার- এ ৪টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত পাঁচশ’ হেক্টর রোপা আমন ও আউশ পাকা ধানের ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন যুগান্তরকে জানান, তার ইউনিয়নের ৬টি গ্রামের রোপা আমন ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। নিচু এলাকায় সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় পুকুরে মাছ ভেসে গিয়ে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)
শুক্রবার ভোররাত থেকে শুরু হয়ে কমলগঞ্জ উপজেলায় সারাদিন টানা বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পানি ও উজানের পাহাড়ি ঢলের কারণে কমলগঞ্জের ধলাই নদীসহ সবগুলো পাহাড়ি ছড়ায় পানি বেড়ে গেছে। পানি বাড়া অব্যাহত থাকলে রাতের মধ্যেই ধলাই নদীতে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে।
কুড়িগ্রাম
জেলার ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারসহ প্রধান প্রধান নদ-নদীতে পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ফলে দ্বীপচর ও নদ-নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে চর, দ্বীপচর ও নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষ। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীতে ৪৬ সেমি., ব্রহ্মপুত্রে ২৬ সেমি. দুধকুমরে ৫৪ সেমি. ও তিস্তায় ৩ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, উলিপুর, চিলমারী ও রাজীবপুরের চরাঞ্চলের বেশ কিছু ঘরবাড়িতে দ্বিতীয় দফা পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
সিলেট
গোয়াইনঘাটে ২ মাসের ব্যবধানে ফের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বর্ষণের ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার মানুষজন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ওঠার কারণে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে দুটি পাথর কোয়ারিও। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুক্রবার পর্যন্ত নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উপজেলার পূর্ব জাফলং, আলীরগাঁও, রুস্তমপুর, ডৌবাড়ি, লেঙ্গুড়া, তোয়াকুল ও নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.