সেদিন যা ঘটেছিল

২০১৬ সালের ১ জুলাই। রাত ৯টা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। একসঙ্গে পাঁচ জঙ্গি অতর্কিত প্রবেশ করে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। তারা ব্যাগ থেকে দ্রুত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র বের করে। কারও হাতে ছিল একে-২২ রাইফেল। কারও হাতে পিস্তল। একজনের হাতে ছিল চাপাতি। অস্ত্র বের করার পর কোনো সময়ক্ষেপণ না করেই এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। বৃষ্টির মতো গুলি চালাতে চালাতে একেকজন একেক দিকে এগোতে থাকে। কেউ প্রবেশ করে মূল রেস্তোরাঁয়। কেউ যায় লনের টেবিলের দিকে, যেখানে বিদেশি অতিথিরা বসে খাবার খাচ্ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে নারকীয় তাণ্ডব শুরু হলে বেকারিতে অবস্থানরতরা যে যেভাবে পেরেছেন আত্মগোপনের চেষ্টা করেছেন। কেউ টেবিলের নিচে ঢুকেছেন। কেউ দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন দোতলায়। এক জাপানি নাগরিক আশ্রয় নেন কোল্ড রুমে। বাইরের লনে বসে থাকা অতিথিদের কেউ কেউ গাছের আড়ালে লুকিয়েছেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন বেকারির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাৎক্ষণিকভাবে কেউই বুঝতে পারেননি, কারা আক্রমণ চালিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলেন লুটপাটের উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়েছে। লুটপাটের পর তারা চলে যাবে। হামলা চালানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা কিলিং মিশন শেষ করে। পুলিশও প্রথমে ভেবেছিল চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে শুরুতেই প্রাণ হারান পুলিশের দুই কর্মকর্তা।
তারা হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন আহমেদ খান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জঙ্গিদের টার্গেট ছিল মূলত বিদেশি অতিথি। বাঙালি বা মুসলিম অতিথিদের তারা সেহরি খাইয়েছে। অভয় দেয়ার চেষ্টা করেছে। তারপরও ২৫ জিম্মির সবারই প্রতি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যু আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। রাতভর খুবই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ছিলেন সবাই। অনেকে বন্দি ছিলেন বাথরুমে। ২ জুলাই সকালে সেনা অভিযানে নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয় জিম্মিদের। এর আগেই হলি আর্টিজানের ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিককে। এদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি। তিনজন বাংলাদেশি। বিদেশিদের মধ্যে নয়জনই ইতালির নাগরিক। তারা হলেন- নাদিয়া বেনেদিত্তি, ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনা মন্তি, মারিয়া রিবোলি, আডেলে পুলিজি, ক্লদিও কাপেল্লি, ক্রিস্টিয়ান রসি ও মার্কো তোন্দাৎ। ভয়াবহ এ হামলায় সাতজন জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, সাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেকো। নিহতদের মধ্যে একজন ভারতীয় নাগরিক। তার নাম তারিশি জৈন। নিহত বাংলাদেশিরা হলেন- ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবির ও ইশরাত আখন্দ।
মৃত্যুর জন্য কালেমা পড়ে প্রস্তুত ছিলেন আকাশ : ‘মারা যাব নিশ্চিত। কালেমা পড়ে রেডি (প্রস্তুত)। তওবা-ইস্তেগফার করছিলাম। কান্নাকাটিও করি। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে, সারাজীবন নামাজ পড়েও কত বড় বড় আলেম ওলামার কলেমা নসিব হয় না। আমি তওবা করে মরতে পারছি। আমার মতো মৃত্যু কয়জনের হয়?’- বুধবার যুগান্তরকে কথাগুলো বলছিলেন হলি আর্টিজান বেকারির সহকারী বাবুর্চি আকাশ খান (২০)। গত বছর ১ জুলাই সেখানে নারকীয় জঙ্গি হামলা ঘটেছিল। আজ এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। ওই হামলার প্রত্যক্ষদর্শীদের অন্যতম একজন আকাশ খান। তিনি জানান, ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার দিন সারারাত তারা ৯ জন একটি বাথরুমে বন্দি ছিলেন। সেখানে দম বন্ধ হয়ে তারা প্রায় মারা যাচ্ছিলেন। সকালে জঙ্গিদের নির্দেশে রেস্টুরেন্টের একজন স্টাফ ও ওয়েটার এসে তাদের বাথরুম থেকে উদ্ধার করে। জঙ্গিদের হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র। শুধু আকাশই নয়, সেদিন হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি ২৫ জনেরই এমন অবস্থা হয়েছিল। তাদের মধ্যে বেকারির ১৪ কর্মচারী ও ১১ জন অতিথি ছিলেন। সেদিন হামলা থেকে চার বিদেশিও বেঁচে ফিরেছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশ। বাংলা বলতে পারায় তিনি বেঁচে যান। জাপানি নাগরিক ওয়াতানাবি তামোকি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি পরিত্যক্ত চুলার পেছনে লুকিয়ে ছিলেন সারারাত। শ্রীলঙ্কান দম্পতি হরিকেশা উইজেসেকেরা ও ফেফতা সায়মা উইজেসেকেরা দম্পতিও ওই চুলার পেছনে লুকিয়ে থাকার কারণে জঙ্গিরা তাদের খুঁজে পায়নি। আকাশ খান যুগান্তরকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ওইদিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কাজে যাই। রাত ৯টার কিছু আগে একটি অর্ডারের মাল কাটছিলাম। হঠাৎ দেখি শেফ দিয়াগো ও জ্যাকপো পেছনের দিকে দৌড়াচ্ছেন আর বলছেন- গো, গো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঘটনা বুঝতে গেস্টদের টেবিলের সামনে যাই। দেখি, গেস্টরা ছোটাছুটি করছেন। টেবিলের নিচে, দেয়াল ও পিলারের পাশে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবলাম, হয়তো ভূমিকম্প হচ্ছে। কারণ এর আগে যখন ভূমিকম্প হয়েছিল তখন গেস্টরা এভাবেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমিও নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দেখি, কাঁধে ব্যাগ ও হাতে অস্ত্র নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ছে এক যুবক। এ দৃশ্য দেখে আমি দ্রুত পালানোর চেষ্টা করি। একটি বাথরুমের সামনে গিয়ে দেখি, অনেকে বাথরুমে আশ্রয় নিয়েছেন। আমিও সেখানে ঢুকে পড়ি।
পরে হোটেল কর্তৃপক্ষকে ফোন করে বলি, হোটেলে সন্ত্রাসী ঢুকেছে। তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠান। এরপর বাথরুমে বসে মোবাইলের মাধ্যমে টিভি চ্যানেলের খবর দেখে ঘটনা জানার চেষ্টা করি। তাছাড়া আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতদের সঙ্গে মোবাইলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি। হঠাৎ বাথরুমের ওপর দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনে মনে করি, পুলিশ এসেছে। সন্ত্রাসীরা পালাচ্ছে। এ সময় আমরা স্বস্তি অনুভব করি। এর কিছুক্ষণ পরই খবরে দেখি, সন্ত্রাসীদের হামলায় দু’জন পুলিশ নিহত হয়েছেন। এ সময় আতঙ্ক বেড়ে যায়। পাশাপাশি বাথরুমে গরমের তীব্রতাও বেড়ে যায়।’ আকাশ বলেন, ‘রাত ২টার দিকে জঙ্গিরা আমাদের বাথরুমের সামনে আসে। তখন ভাবি, আজরাইল এসে গেছে। এখন জানটা কবজ করবে। তখন যে আমাদের কেমন লেগেছে বলে বোঝাতে পারব না। তারা দরজায় নক করে বলে, ভেতরে কারা আছ? বের হও। আমরা কোনো কথা না বলায় তারা হুমকি দেয়, বের না হলে গ্রেনেড মেরে সব উড়িয়ে দেব। এক পর্যায়ে দরজা খুললাম। অস্ত্রের মুখে তারা জানতে চাইল, কোনো ফরেনার আছে কিনা। আমরা নাসূচক জবাব দেয়ার পর তারা আমাদের সবাইকে চেক করে। পরে তারা বাথরুমের ভেতরে রেখে দরজা বাইরে থেকে আটকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। তখন অক্সিজেনের অভাবে আমাদের জীবন যায়যায়। সবাই বাথরুমের ফ্লোরে শুয়ে দরজার নিচের সামান্য ফাঁকে নাক ঠেকিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে আমাদের মনে হল- এভাবে মৃত্যুর চেয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মরাই ভালো। তাই দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছিলাম আর বলছিলাম, আমাদের বাঁচান। সকাল ৬টা-৭টার দিকে জঙ্গিদের নির্দেশেই একজন স্টাফ ও একজন ওয়েটার এসে দরজা খুলে দেয়। তখন ভেবেছিলাম পুলিশ প্রশাসনের লোক ভেতরে ঢুকেছে। সন্ত্রাসীরা চলে গেছে। তাই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার আগে আমি গেস্টদের অবস্থা দেখতে চারপাশ ঘুরছিলাম। দেখলাম চারপাশে লাশ আর জমাটবাঁধা রক্ত। হোটেলের অবস্থা একেবারে তছনছ। ধারণা হচ্ছিল, সন্ত্রাসীরা ভেতরে ঢোকার এক ঘণ্টার মধ্যেই হত্যাযজ্ঞ শেষ করেছে। আকাশ বলেন, ‘সকালে আমরা দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে আশ্রয় নিই। সেখানে আরও কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর গুলি শুরু হয়। আমরা বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করি। সেনা সদস্যরা আমাদের কাছে গিয়ে অস্ত্র তাক করে সবাইকে নিচে আসতে বলে। এ সময় মুহূর্তে আমি একজন সেনা সদস্যের কাছে জানতে চাই, সন্ত্রাসীদের কী হয়েছে? তিনি জানান, গুলিতে সব সন্ত্রাসী মারা গেছে। পরে নিচে নেমে এসে দেখি একসঙ্গে পাঁচ জঙ্গির লাশ পড়ে আছে। সেনা সদস্যরা আমাদের উদ্ধারের পর হলি আর্টিজানের পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে নেয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে।’ ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশের জবানবন্দি : ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশ গুলশান হামলার ২৬ দিন পর আদালতে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন, সেদিন বাংলা বলতে পারায় বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি। তিনি বাঙালি কিনা জঙ্গিরা তার কাছে জানতে চেয়েছিল। তিনি তাদের বলেছেন, ইয়েস, আমি বাঙালি। তার ভাষ্য, জঙ্গিরা ভেতরে ঢুকে বিদেশি নাগরিকদের নির্বিচারে কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে।
প্রথমদিকে জঙ্গিরা গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পরে তারা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। রাত ১২টা পর্যন্ত জঙ্গিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তার ভাষ্য, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত পার হয়েছে আতঙ্কে। তাদের আদৌ বাঁচিয়ে রাখা হবে কিনা তা অনুমান করতে পারছিলেন না। তারা ধরেই নিয়েছিলেন, নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। রাতে বাইরে থেকে জঙ্গিদের কাছে আসা অভিনন্দন বার্তাও তারা পড়ে শোনায়। সাত প্রকাশ জানান, জিম্মিদের সেদিন সেহরি খেতে বলা হয়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্দেহ এড়াতে সেদিন তিনি অন্যদের সঙ্গে সেহরি খান। সাত প্রকাশ ঢাকায় একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। কয়েক বছর ধরেই তিনি ঢাকায় আছেন। তিনি সেদিন ডিনার করতে হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে এক বন্ধুর যোগ দেয়ার কথা ছিল। এর আগেই জঙ্গিরা সেখানে হামলা চালায়। যেভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন ওয়াতানাবি তামোকি : জাপানি নাগরিক ওয়াতানাবি তামোকি জাইকার হয়ে বাংলাদেশে কাজ করতেন। তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তাদের কাছে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, সেদিন গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তিনি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তারপর তিনি পরিত্যক্ত চুলার পেছনে আশ্রয় নেন। সারারাত তিনি সেখানেই ছিলেন। জঙ্গিরা তাকে খুঁজে পায়নি। পরদিন ভোরে কমান্ডো অভিযান শেষে তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে ঢাকার সম্মিলিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৩ জুলাই তিনি টোকিও ফিরে যান।

No comments

Powered by Blogger.