প্রতিযোগিতা আইন বাস্তবায়নে আর দেরি নয়

গত ২০ জুন বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ নিয়ে এক কর্মশালায় বক্তব্য প্রদানকালে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি, জোটবদ্ধতার মাধ্যমে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ করতে সরকার ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন পাস করেছে। সে মোতাবেক প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়েছে। দেশে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা কমিশন সে লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, পাঁচ বছর আগে জাতীয় সংসদে ‘প্রতিযোগিতা আইন-২০১২’ বিল পাস এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর তা বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কোনো পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ এবং ক্ষেত্রমতো পণ্যের গুদামজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য হবে। তবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত নয় এমন পণ্য ও সেবা এ আইনের আওতাবহির্ভূত থাকবে।
রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভের তারিখ অর্থাৎ ২০১২ সালের ২১ জুন থেকে আইনটি কার্যকর হওয়ার চার বছর পর একজন চেয়ারম্যান ও দু’জন সদস্য নিয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন ছাড়া দীর্ঘ সময়ে আইনটি বাস্তবায়নে বিধিমালা প্রণয়নসহ উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা যায়নি। সুতরাং আইনটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন কেন জরুরি তা আলোচনা করাই মূলত এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ প্রণয়নের উদ্দেশ্য আইনটিতেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করার, নিশ্চিত ও বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি ও ওলিগপলি অবস্থা, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহারসংক্রান্ত প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন দেখা যাক আইনটির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী। আইনটির উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এটির ৫ ধারায় প্রতিযোগিতা কমিশন নামে একটি কমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান করা হয়েছে। একজন চেয়ারপারসন এবং অনধিক চারজন সদস্য নিয়ে এ কমিশন গঠিত হবে। চেয়ারপারসন ও সদস্যরা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য হবেন এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কমিশন সরকারের কাছে দায়ী থাকবে। চেয়ারপারসন কমিশনের প্রধান নির্বাহী হবেন। চেয়ারপারসন ও সদস্যরা তাদের কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে ৩ বছর মেয়াদের জন্য নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন এবং অনুরূপ একটি মাত্র মেয়াদের জন্য পুনঃনিয়োগের যোগ্য হবেন। আইনের ৮ ধারায় কমিশনের দায়িত্ব ও কার্যাবলির বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- ক. বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনগুলোকে নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা ও বজায় রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা; খ. কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা স্বপ্রণোদিতভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতাবিরোধী সব চুক্তি, কর্তৃত্বময় অবস্থান এবং অনুশীলনের তদন্ত করা; গ. এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের তদন্ত পরিচালনা এবং তার ভিত্তিতে মামলা দায়ের ও পরিচালনা করা; ঘ. জোটবদ্ধতা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, জোটবদ্ধতার জন্য তদন্ত, শর্তাদি নির্ধারণ এবং জোটবদ্ধতা অনুমোদন বা নামঞ্জুর সম্পর্কিত বিষয়াদি নির্ধারণ করা; ঙ. প্রতিযোগিতাসংক্রান্ত বিধিমালা, নীতিমালা, পরিপত্র ইত্যাদি প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা; চ. প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতাসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য উপযুক্ত মানদণ্ড নির্ধারণ করা; ছ. প্রতিযোগিতাবিরোধী কোনো চুক্তি বা কর্মকাণ্ডসহ জনগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত সব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা; জ. সরকার কর্তৃক প্রেরিত প্রতিযোগিতাসংক্রান্ত যে কোনো বিষয় প্রতিপালন, অনুসরণ বা বিবেচনা করা; ঝ. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের বিষয়ে অন্য কোনো আইনের অধীন গৃহীত ব্যবস্থাদি পর্যালোচনা করা; ঞ. অর্পিত দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পাদনের প্রয়োজনে, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, কমিশন কর্তৃক বিদেশি কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা; এবং ট. এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ফি, চার্জ বা অন্য কোনো খরচ ধার্য করা। কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে বা কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে এ আইনের অধীন উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পারবে। আইনটির ধারা ৮(৩) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে কমিশনে হাজির করার জন্য নোটিশ জারি ও উপস্থিতি নিশ্চিত করা, কোনো দলিল উদ্ঘাটন ও উপস্থাপন করা, কোনো অফিস থেকে প্রয়োজনীয় কাগজাদি বা তার অনুলিপি তলব করা, সাক্ষীর জিজ্ঞাসাবাদ ও দলিল পরীক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়ে কমিশন একটি দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। আইনটি লংঘনে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা প্রতিদিনের ব্যর্থতার জন্য অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করা যাবে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশে প্রতিযোগিতা আইন চালু রয়েছে এবং এসব দেশের জনগণ আইনটির সুফল ভোগ করে আসছে। এফবিসিসিআইসহ বড় বড় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মতামত নিয়ে প্রণীত প্রতিযোগিতা আইন-২০১২-এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন একাধিক কারণে জরুরি হয়ে পড়েছে- ১. ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের দেশের সারিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অসম প্রতিযোগিতা হ্রাস করে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রয়োজন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই প্রতিযোগিতা আইন প্রয়োজন। যেসব দেশ আগে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে, তারা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে গেছে। কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ২. আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে তা সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে সহায়তা করবে। ৩. আইনটি ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে। এ আইন সুলভ মূল্যে উন্নতমানের পণ্য পাওয়া এবং ভোক্তাদের জন্য পণ্যকে সহজতর করে তুলবে। ৪. পণ্য ও সেবা উভয়ই এ আইনের আওতায় এসেছে। আইনটি প্রণীত হওয়ার পর এফবিসিসিআইয়ের একজন উপদেষ্টা একটি বাংলা দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আর্থিক সেবা খাতে ব্যাংক ও বীমার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ব্যাংকগুলোর একত্রে বসে সুদের হারের সীমা নির্ধারণ এ আইনের চোখে প্রতিযোগিতাবিরুদ্ধ; তাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। কোনো পণ্যের দাম আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার পর যদি সে দামে বিক্রি না হয়, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য হবে। যেমন- ওষুধ প্রশাসন ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয়। একইভাবে পরিবহন খাতে কোনো রুটে এক বা দুটির বেশি কোম্পানির বাস পরিচালনা করতে না দেয়াও প্রতিযোগিতাবিরুদ্ধ বিবেচিত হয়। ৫. প্রতিযোগিতা আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে যে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন, তাদের অপচেষ্টায় বাধা দেয়া সম্ভব হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। চালকল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে বোরোর ভরা মৌসুমে জনগণকে ৪৬-৪৮ টাকায় এক কেজি মোটা চাল কিনতে হচ্ছে; আইনটি বাস্তবায়িত হলে এমন পরিস্থিতি উদ্ভবের সম্ভাবনা বহুলাংশে কমে যাবে। রমজান বা ঈদের মতো উৎসবে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াতে পারবেন না। সবশেষে যা বলতে চাই তা হল, ব্যবসায়ী ও জনগণ উভয়ের স্বার্থে প্রতিযোগিতা আইন-২০১২-এর সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। যেসব দেশে প্রতিযোগিতা আইন সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, সেসব দেশের ব্যবসায়ী ও জনগণ উভয়ের জন্য তা সুফল বয়ে এনেছে। আমরা সেসব দেশে সরকারি ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি এবং লব্ধজ্ঞান দেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রয়োগ করতে পারি। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য বিধি প্রণয়নের বিকল্প নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় আইনটি ভূমিকা রাখলে তা জনগণের দৃষ্টিতে সরকারের একটি বড় সাফল্য বলে বিবেচিত হবে। আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
 latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.