বস্তুর বর্জ্য সরাচ্ছেন মেয়রদ্বয় চিন্তার ময়লা ফেলব কোথায়?

রূঢ় সত্য শুনতে আমাদের ভালো ঠেকে না। উল্টো, রাজনীতির কিছু কিছু অযৌক্তিক কথা বারংবার উচ্চারিত হতে হতে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত সত্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে। কথাগুলো এক ধরনের আপ্তবাক্যও বটে। এগুলোকে আমরা সেট-আইডিয়া বা পূর্ব-নির্ধারিত ধারণাও বলতে পারি। এ ধরনের একটি কথা হল, জনগণ কখনও ভুল করে না বা ভুল রায় দেয় না। দেখুন, জনগণ যদি ভুল রায় না-ই দেয়, তো দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এমপি হলেন কীভাবে? নাকি সেটাই সঠিক রায়? অবশ্য সাঈদীর নির্বাচনী এলাকার বাইরেও এমন লোক পাওয়া যাবে, যারা বলবে রায় সঠিক। আদালতের রায়ের পরও তারা সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বাজায়। আবার দেখুন, জার্মানির জনগণ হিটলারের পক্ষে রায় দিয়ে পৃথিবীটাই ধ্বংস করার আয়োজন করেছিল। জনগণ যদি ভুল না-ই করে, তাহলে গণউন্মাদনা (mass insanity) কথাটার উদ্ভব হল কেন? বাংলাদেশের দুই গ্রামের জনগণ যখন তুচ্ছ কারণে একে অন্যের রক্তপাত ঘটায়, সেটা সঠিক রায়? এবার চলুন- বলা হয় জনগণই ক্ষমতার উৎস। এ কথার সম্পূরক হিসেবে আরেকটি কথা চালু আছে- স্বৈরাচার বা একনায়ক বেশিদিন টিকতে পারে না, তাদের পতন অনিবার্য। প্রথম কথা, আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে জনগণের সমর্থনে নয়, বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসেছেন অনেকে। দ্বিতীয় কথা, একনায়ক যদি টিকতে না-ই পারে, তাহলে ফ্রাঙ্কো কীভাবে ৩৬ বছর স্পেন শাসন করেছেন? স্ট্যালিনই বা কীভাবে প্রায় ৩০ বছর থাকলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় অথবা মার্কোস দুই দশক ফিলিপাইনে? ফ্রাঙ্কো, স্ট্যালিন অথবা জনহিতৈষী নাকি গণবিরোধী বিতর্কটি উহ্য রেখে ফিদেল কাস্ত্রোকে যদি কেউ একনায়ক বলতে চান, তাহলে তিনিসহ এদের কেউই ক্ষমতাচ্যুত হননি, আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে সবার। মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন; কিন্তু সেটা কতদিন পর? কুড়ি বছর ক্ষমতাভোগের পর উপভোগের আর বাকি থাকে কী? ক্ষমতা গ্রহণ করতে না করতেই যদি ক্ষমতা জবরদখলকারী কোনো একনায়ককে সরানো যায়, সেটাই হতে পারে জনগণের কৃতিত্ব। এ পর্যায়ে জাত মার্কসবাদীরা নিশ্চয়ই আমাকে ধরে ফেলবেন। বলবেন, দুর মিয়া।
প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড় টেনে আনলেন! আমাদের মহান তাত্ত্বিক নেতা মাও জে-দং অনেক আগেই জনগণের শক্তিকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, political power comes out of the barrel of a gun! আরেক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস রয়েছে রাজনীতিতে। সেটা হল, হুদা কামে (শুধোশুধি) বিকল্প খোঁজা। একটা উদাহরণ দিই। গণতন্ত্রের চর্চা কীভাবে হচ্ছে- সেটা প্রেসিডেন্সিয়াল, না পার্লামেন্টারি পদ্ধতির- এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। শাসকশ্রেণী নির্বাচিত কিনা এবং তারা আইনের অধীনে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ কিনা অর্থাৎ তাদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা আছে কিনা, সেটাই আসল কথা। অগণতান্ত্রিক তো বটেই, যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারপদ্ধতিতে আলটিমেটলি একটা সিঙ্গল অথরিটি তৈরি হয়, অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টই মূল ক্ষমতাটা প্রয়োগ করেন। প্রেসিডেন্টের বদলে প্রধানমন্ত্রী দেশশাসন করছেন, এটা কোনো কাজের কথা নয়, যদি না তার ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতি গণতান্ত্রিক হয়। যুক্তরাষ্ট্র অথবা ধরুন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি এশিয়ার অনেক দেশের পার্লামেন্টারি পদ্ধতির চেয়ে গণতন্ত্রসম্মত। দেশ দু’টির প্রেসিডেন্টের স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার (অন্তত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে) কোনো সুযোগ নেই, এশিয়ার প্রধানমন্ত্রীদের তা রয়েছে, কোথাও বা সেই সুযোগ অবারিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজেনআওয়ার তো একবার আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে, দশ মিনিটের জন্যও যদি আমার হাতে একইসঙ্গে প্রেসিডেন্সি ও সিনেট থাকত, আমি তাহলে আমেরিকানদের জন্য অনেক কিছু করতে পারতাম; কিন্তু হায়! আমি শুধুই প্রেসিডেন্ট (Alas! I am only the president!)! ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিতে পারেন, কিন্তু পারেন না যাকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন, তাকে ডিসমিস করতে। তো ’৯১-এ আমরা প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির বিকল্প খুঁজলাম এবং নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনেই এই লক্ষ্যে সাপে ও নেউলে বন্ধুত্ব হল। দুই চরম শত্রুভাবাপন্ন দল মধ্যরাতে হৈ-হুল্লোড় করে পাস করল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির বিল। হ্যাঁ, পার্লামেন্টারি সিস্টেম কথাটা শুনতে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের চেয়ে মধুর অনেকের কাছে; যদিও দুই সিস্টেমেরই ভালো ও মন্দ দুই দিক রয়েছে। বাস্তবে লাভটা হল কী?
লাভ হয়নি, কারণ বিকল্প খোঁজার আগে কেন তা খুঁজেছি তা বুঝতে চাইনি। শুধু বুঝেছি প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের চেয়ে গণতন্ত্রী! আর এই পদ্ধতিটার পরিবর্তন হল; কিন্তু সিঙ্গল অথরিটিটা কীভাবে কাজ করবে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা হল না। তখন অথবা পরবর্তীকালে কখনও আইনের অধীনে জবাবদিহিতা অথবা দায়বদ্ধতার বিষয়টি অ্যাড্রেস করা হয়নি, নেয়া হয়নি রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত করার চেষ্টা, তাই বলেছি হুদা কাম। আরেকটি হুদা কামের বিকল্প খোঁজার কথা বলি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্মেলনের সময় যখন যথাক্রমে প্রেসিডিয়াম ও স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন হুদা কামে বলা হয়- অমুককে নেয়া উচিত ছিল, তমুককে বানানো ঠিক হয়নি; উনি অপদার্থ তো ইনি পদার্থ ইত্যাদি। অথচ কেউ ভাবি না, দল দুটি যেভাবে চলে; একটি সভানেত্রীর, আরেকটি চেয়ারপারসনের একক খেয়ালে, তাতে পুরো প্রেসিডিয়াম অথবা স্ট্যান্ডিং কমিটি অপদার্থ বা পদার্থ যে-কোনোটি দিয়ে গিজগিজ করলে তাতে রাজনীতির ইতরবিশেষ কিছু হবে না। কথিত এই দুই হাইয়েস্ট বডির কেউ একজন যত মূল্যবানই হোন, নেত্রীদ্বয়ের দৃষ্টিতে তিনি ঘাস কিংবা বড়জোর লতাগুল্মের অধিক কিছু নন। এভাবে বিকল্প না খুঁজে বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রক্রিয়ায় দল দুটিতে যে সাংগঠনিক গলদ রয়েছে, তা সারানোর তাগিদ দেয়াটাই জরুরি। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে চিন্তার আরেক ধরনের দোষের কথা বলি। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো লেখক নানা দোষের কথা বলে হেয়প্রতিপন্ন করতে বাঙালিকে স্যাটায়ার করে ‘বাঙাল’ বলেছেন। কেউ এমনও লিখেছেন, বাঙাল জাত বড় খারাপ! তো দেখুন, এই খারাপ আবার কতটা খারাপ হয়! ধরুন, বিএনপিমনা কারও সঙ্গে কথা হচ্ছে। তাকে বলা হল- বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে তো দেশের অবস্থা আরও খারাপ হবে, এখন মাসে ১০টা ক্রসফায়ার হচ্ছে, তখন ১০০টা হবে। তিনি তখন বলবেন- এটা তো হাইপোথেটিক্যাল কথা হয়ে গেল, আগাম বুঝলেন কীভাবে? এরপর তাকেই বলা হল- বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে যে সেটা সুষ্ঠু হবে না, বোঝেন কীভাবে? তিনি তখন বলবেন- এটা না বোঝার কী আছে! দেখলেন তো, ভবিষ্যতের একটি বিষয় হাইপোথেটিক্যাল, আরেকটি সায়েন্টিফিক!
২. উপরের কথাগুলো ঢ়ৎবধসনষব বা গৌরচন্দ্রিকা। মূল প্রতিপাদ্য আমাদের চিন্তার এক বিশেষ ধরনের ময়লা। দেখুন, কথাটা হাস্যরসাত্মক অথচ তাকে সিরিয়াস বলে চালানোর চেষ্টা হয়। গুরুত্বহীন কথাটা হল, দেশের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে হত্যাকারীর শাস্তি না হওয়ার কারণে, তাই তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর হিসাব রাখতে হলে একজন হিসাবরক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, তবে মাঝে মাঝে যেসব হত্যাকাণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে, সেগুলোর ওপর লেখালেখি কিংবা টকশোয় উপরের প্রেসক্রিপশনটি বলা যায় কমন। স্বাভাবিকভাবেই বলতে হয়, যিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকেই রেমেডি মনে করছেন, হত্যা প্রতিরোধের কার্যকর উপায় তার জানা নেই। হত্যা দমনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ভূমিকা নগণ্য, তবে নিশ্চয়ই তার মানে এই নয় যে, হত্যাকারীর জন্য দায়মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। হত্যাকারীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে, এই দায় নৈতিক, আদর্শিকও বটে। তার চেয়ে বড় কথা, শাস্তিটা পাপের। কিন্তু সেই শাস্তির ব্যবস্থা করে তাকে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ আখ্যা দিয়ে তুড়ি বাজানোর কোনো সুযোগ নেই যে, তাতে হত্যাপ্রবণরা দুধের নহরে গোসল করে কসম কাটবে তারা পুতপবিত্র হয়ে গেছে। ধর্মীয় ইতিহাস অনুযায়ী, এই পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ছিল জগতের প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের একজনের। কাবিল হত্যা করেছিল ভাই হাবিলকে। সেই থেকে মানবেতিহাসের প্রতি ধাপেই হত্যাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু সেসব শাস্তি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হয়ে অপরাধপ্র্রবণদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যেহেতু বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হত্যার প্রতিষেধক, আমাকে তাই পাঠকদের একটি অনুরোধ করতেই হয়। আর্কাইভ থেকে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার দুই কী তিনদিন পরের পত্রিকায় তারা পড়তে পারবেন একটি খুনের খবর। শিকদারের ফাঁসির সংবাদটি ছিল দেশময় চাঞ্চল্যকর, এই হত্যাকারী নিশ্চয়ই পড়েছিল অথবা জেনেছিল তা। এই উদাহরণ না হয় বাদই দিলাম। এই যে কয়েকদিন পরপরই শিরোনামে দেখছি- অমুকের মৃত্যুদণ্ড, তমুকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এগুলোর কোনোটিই কি দৃষ্টান্তমূলক হতে পারছে? যদি পারে, তবে প্রায় প্রতিদিনই কেন হত্যাই দখল করে রাখছে পত্রিকা অথবা টেলিভিশনের অন্তত ২০ শতাংশ? হত্যাকারীর শাস্তি যে হত্যা প্রতিরোধমূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করছে না, তার কারণটা বোঝা চাই। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় দু’ভাবে। একটি পরিকল্পিত হত্যা, অন্যটি ঘটে হত্যাকারীর মুহূর্তের উত্তেজনায়। মুহূর্তের উত্তেজনায় যে হত্যাকাণ্ড, তা পুরো সমাজটিকেই নিরুত্তেজ করা ছাড়া ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। এ ধরনের হত্যা প্রবৃত্তিগত। উদাহরণটা এমন হতে পারে, ঘাড়ের ওপর তেলাপোকার অস্তিত্ব টের পেলে যেমন ফ্র্যাকশন অফ অ্যা সেকেন্ডে শরীর ঝাড়া দিয়ে সেটাকে সরাই আমরা, এজন্য কোনো পূর্বচিন্তা বা পরিকল্পনার দরকার হয় না, ঠিক তেমন কখনও কখনও মানুষ মুহূর্তের উত্তেজনায় আগ-পাছ না ভেবে রিপুতাড়িত হয়ে অন্যকে আক্রমণ করে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা ভাবার সময় কই তার? মানুষভেদে ভিন্ন হয় রিপু, আবার সামাজিক পরিস্থিতিও রিপু নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাধীনতা-পূর্ব এই অঞ্চলেই মানুষের রিপু এত আগ্রাসী ছিল না, রাজনৈতিক আন্দোলনের সময়টুকু বাদ দিলে তখনকার সমাজ সাধারণভাবে এখনকার চেয়ে অনেক অনেক নিরুত্তেজ, নিরুত্তাপ ছিল বলেই পরিকল্পিত ও মুহূর্তের উত্তেজনাবশত হত্যা দুই-ই খুব একটা ঘটত না।পরিকল্পিত হত্যা যারা ঘটায়, তারা যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ধার ধারে না, তা বুঝতে হলে ক্রিমিনাল সাইকোলজি বোঝা চাই। হত্যাকারী যখন হত্যার পরিকল্পনা করে, তখন সে ধরেই নেয় সে ধরা পড়বে না। তার ধারণা থাকে, পরিকল্পনাটি এত নিখুঁত যে, তা ভেদ করা যাবে না। তো যে ধরেই নিয়েছে ধরা পড়বে না, তার চোখের সামনে হাজারটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ঝুলে থাকলেই কী? আমাদের এই অবদমনমূলক ও নিবিড় সমাজে যে অসম যৌনতার ঘটনার সংখ্যা অত্যধিক,
তার কারণও প্রায় একই। যারা এটা ঘটায়, তারা যদি মনে করত ধরা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে সমাজে মাথা কাটা যাবে এই ভয়ে এ কাজে লিপ্ত হতো না। তাদের বিশ্বাস তারা দু’জন ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ তা জানবে না। তাহলে এখন কী করা? হ্যাঁ, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের একটি বড় উপায় হল- বিচারের প্রশ্ন পরে, সমাজে এমন এক আবহ তৈরি করে রাখতে হবে, যাতে হত্যাপ্রবণদের মাথায় এই সত্য গেঁথে যায় যে, তারা যতই সুপরিকল্পনা করুক না কেন, জালে আটকা পড়তেই হবে তাদের। ব্রিটেনের কথা বলব না, কন্টিনেন্টাল ইওরোপ, বিশেষত স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলোর সমাজে এই আবহ তৈরি করে রাখা হয়েছে। আর এ কারণেই স্ক্যানডিনেভিয়ানরা বাস করছেন মোটামুটি জিরো ক্রাইম জোনে। নিজেকে অপরাধমুক্ত রাখাটা হার্ড-আর্নড ফরেন কারেন্সির মতো কষ্টার্জিত কোনো কোয়ালিটি নয়। চোখ থাকলেই যেমন দেখা যায়, কান থাকলে যায় শোনা, এজন্য আলাদা পরিশ্রম করতে হয় না; তেমনি বিবেক থাকলেই অপরাধমুক্ত থাকা যায়। এত সোজা একটি কোয়ালিটি যে অর্জন করতে চায় না, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ভয় দেখিয়ে অথবা ভিজে গামছা দিয়ে তার পিঠ মুছতে মুছতে খ্রিস্টীয় দরদমাখা গলায় শত উপদেশ শুনিয়ে লাভ নেই। তাকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করাতে হবে যে, টাকা অথবা প্রভাবশালীরা তোমাকে বাঁচাতে পারবে কী পারবে না সেটা পরের প্রশ্ন, হত্যা করলে আপাতত তোমাকে জালের ভেতর ঢুকতেই হবে। সময় নেই, ঈদের কেনাকাটা করতে হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রতিদিন লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা নাড়াচাড়া করছেন। এদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তির মানসিকতাসম্পন্ন রয়েছেন নিশ্চয়ই কেউ কেউ। তো তারা এত এত টাকার মধ্যে দু-এক হাজার টাকাও কেন চুরি করছেন না? সেটা কি এ কারণে যে, তাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে চুরি করলে শাস্তি হয়? আসলে তারা তা করছেন না, কারণ সিস্টেমটাই এমন টাকাটা ঠিক কার কাছে থেকে খোয়া গেছে, দিনের শেষে তা শনাক্ত হয়ে যাবে।
পুনশ্চঃ এই লেখাতে বলেছি হত্যা প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ভূমিকা নগণ্য। সিরিয়াস পাঠকদের কেউ এই নগণ্যের পরিমাণ শতকরা হিসাবে বুঝতে চাইতে পারেন। অঙ্কশাস্ত্র কিংবা পদার্থবিদ্যায় বিশেষ কোনো প্রবলেম ওয়ার্ক-আউট করার সময় আলফার মান এত ক্ষুদ্র আসে যে, তা ইগনোর করা চলে। এই নগণ্যও তেমন। অবশ্য কোন্টাকে গুরুত্ব দিতে হবে, কীসে দিতে হবে বিশেষ গুরুত্ব অথবা কাকে উপেক্ষা করতে হবে- আমিও যে খুব একটা বুঝি, তা নয়।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@Yahoo.Com

No comments

Powered by Blogger.