সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণ প্রসঙ্গে

ইসলামকে বাংলাদেশের রানা রঙের ইসলামপন্থীরা যেভাবে খেলা করার চেষ্টায় লিপ্ত আছে এবং অনেকাংশে তা করেছে, এটা এই অঞ্চলে আগে কখনও দেখা যায়নি। ইসলামের ইতিহাসেও এটা এভাবে দেখা যায় না। ইসলামের সব থেকে পবিত্র স্থান হল কাবা। এই কাবা মুসলমানরা তৈরি করেনি। করেছিল পূর্ববর্তী আরব মূর্তি পূজারিরা। তার ভেতরে অনেক মূর্তি বা পুতুল ছিল যা তারা পূজা করত। মুসলমানরা মক্কা দখল করার পর খোদ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক কাবাকে ইসলামের পবিত্রতম জায়গা ঘোষণা করে সেখান থেকে মূর্তিগুলো সরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো তারা ভেঙে ফেলেননি। মুসলমানদের জন্য মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ মূর্তি তৈরি করলে অথবা বিভিন্ন জায়গায় ও দেশে মূর্তি থাকলে সেগুলো ভেঙে ফেলার কোনো চিন্তা ইসলামে ছিল না। চার খলিফার সময় থেকে পরে উমাইয়া, আব্বাসীয় এবং তুর্কি খলিফারাও কেউ ইরান, সিরিয়া, তুর্কি ও ইরাকে যেসব বিখ্যাত মূর্তি ও উপাসনালয় ছিল সেগুলো ভেঙে ফেলেননি। উপরন্তু তাদের দ্বারা সেগুলো সুরক্ষিত ছিল। মূর্তি ভাঙার নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে ইসলামিক স্টেটের মতো ইসলাম নামধারী ক্রিমিনাল সংগঠন। আসলে বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষার নামে যারা মূর্তি সরানো এবং মূর্তি ভাঙার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করছে এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থন লাভ করে এখন জোরদার হয়েছে, তারা ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পরবর্তী ইসলামের খলিফাদের অনুসারী নন। তারা হলেন ক্রিমিনাল ইসলামিক স্টেটের অনুসারী। ইরাক ও সিরিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে ইসলামিক স্টেটের প্রধান আবুবকর বাগদাদী ধর্ষণ,
হত্যা থেকে নিয়ে সব রকম অপকর্ম চালিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ইরাক ও সিরিয়ার অতি মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ধ্বংস করেছে। এটা বর্বরদের কাজ। ইসলামে এ ধরনের বর্বরতার কোনো স্থান নেই। আগেই বলেছি, ইসলামের সব থেকে গৌরবজনক সময়েও এ ধরনের ভাস্কর্য ও মূর্তি অপসারণ বা ভাঙার কোনো উদাহরণ নেই। এমনকি আল কায়দার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনও মূর্তি এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করার কোনো আওয়াজ তোলেনি। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ইসলামিক স্টেট মার্কা তালেবানদের দ্বারা আফগানিস্তানে বুদ্ধের এক বিশাল মূর্তি ধ্বংস করা। কাজেই ইসলামিক স্টেটের নব্য অনুসারী হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত ওলামা লীগ এবং আওয়ামী লীগ দল ও তাদের সরকারকে ব্যাখ্যা করতে হবে ইসলামের কোন্ অনুশাসনের বলে তারা ভাস্কর্য ও মূর্তি সরানো ও ভাঙার আন্দোলন করছেন এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তাকে সমর্থন করছেন। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কওমী মাদ্রাসার মর্যাদা নিয়ে সমঝোতা করার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনিও সুপ্রিমকোর্টে ওই মূর্তি বসানো পছন্দ করেন না! দেশের জনগণের কাছে তাকেও এই অপছন্দের ব্যাখ্যা দিতে হবে। কারণ তার দাবি হল জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সরকার গঠন করেছেন। ইসলামের কোন ঘরানার লাইন অনুযায়ী এসব করা হচ্ছে সে বিষয়ে জানার অধিকার জনগণের আছে। হেফাজতে ইসলামের নেতারা সুপ্রিমকোর্টের ভেতর থেকে ভাস্কর্য অপসারণের পর বলছেন, এর মাধ্যমে জনগণের চিন্তার জয় হয়েছে! কিন্তু কোথায় জনগণ? শুক্রবার মসজিদগুলো থেকে অনেক নিরীহ মুসল্লিকে বিভ্রান্ত করে রাস্তায় নামানো হয়েছে মূর্তি অপসারণের দাবিতে। বাংলাদেশের জনগণ বলতে কি তাদেরকেই বোঝায়? এর বাইরে দেশে যে কোটি কোটি মানুষ আছেন তারা কি জনগণ নন? সে জনগণের মতামত কি এ ক্ষেত্রে নেয়া হয়েছে? যেখানে নির্বাচনের সময়েও ভোটের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটার কোনো ব্যবস্থা বা নিশ্চয়তা নেই, সেখানে ভাস্কর্য সরানোর ব্যাপারে দেশের জনগণের সম্মতির কথা কীভাবে জানা গেল? হেফাজতে ইসলাম এবং তাদের মতো অন্যদের এই দাবি সম্পর্কে সরকারের নীরবতাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আসল কথা হল, ইসলামী সংগঠনগুলোর দ্বারা বাংলাদেশে এখন ধর্ম হিসেবে ইসলাম চর্চিত হচ্ছে না। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের ধর্মান্ধ,
সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির হাতিয়ার। এর থেকে ইসলামবিরোধী কাজ আর কী হতে পারে? এ বিষয়ে যারা ইসলাম ধর্মের সত্যিকার অনুসারী তাদের চিন্তা করা ও সাবধান হওয়া কি উচিত নয়? ধর্মের এবং এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের নামে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও তাদের নেতাদের যে কর্মকাণ্ড চলছে, এর থেকে ইসলামকে খেলো করার অপচেষ্টা আর কী হতে পারে? ইসলামী সংগঠন নামে এ ধরনের সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিএনপির আঁতাত বেশ স্পষ্ট ও খোলাখুলি। তারা এ নিয়ে কোনো সময় লুকোচুরি খেলেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে সব সময়ে তাদের মতো একই অবস্থানে থাকলেও এ নিয়ে তারা বরাবর লুকোচুরি খেলে এসেছে। তাছাড়া খোলাখুলিভাবেই তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন, খেলাফত মজলিসের সঙ্গে ব্লাসফেমি আইনসহ অন্য প্রতিক্রিয়াশীল কর্মসূচি নিয়ে চুক্তি করেছিল যাতে তাদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল স্বাক্ষর করেছিলেন এবং এখন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। এখন সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা আছে। এসব হঠাৎ করে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের এ ধরনের নীতি ও কার্যকলাপের একটা ধারাবাহিকতা আছে। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা এখন ভাস্কর্য অপসারণ নিয়ে এমনভাবে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন যে মনে হয় এটা হঠাৎ এবং ব্যতিক্রমী একটি ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা যা করছে তার পেছনে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের যে সম্পর্ক আছে তাকে তারা কৌশলের সঙ্গে বরাবর আড়াল করে আওয়ামী লীগকে একটি খাঁটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মবিযুক্ত সংগঠন হিসেবে প্রচার করে এসেছেন ও তাকে সমর্থন করেছেন। কাজেই আজ আওয়ামী লীগ সরকার ও সংগঠন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে খোলাখুলি ঐক্য প্রতিষ্ঠার যে কাজ করছে তার জন্য শুধু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনকে দায়ী করলেই হবে না, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও দীর্ঘদিন ধরে যে ভূমিকা পালন করে এসেছেন তার হিসাবও নিতে হবে। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী সরকারের থেকে নানাভাবে যেসব সুযোগ-সুবিধা লাভ করে তাদের সমর্থন করেছেন সে বিষয়টিকেও এ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যাবে না। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আওয়ামী লীগের এখন খোলাখুলি এই অবস্থান গ্রহণ করা যে তাদের দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ এবং যে কোনো প্রকারে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই তাদের এই সুবিধাবাদের কথাও তাদের এই নব্য বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশ্য সভা-সমিতি, বিবৃতি ও লেখালেখির মাধ্যমে বলতে হবে। সেটা না করে কতকগুলো মামুলি কথাবার্তা বলে ভাস্কর্য অপসারণের বিরোধিতা করলে তার দ্বারা কিছুই হবে না এবং হওয়ার নয়।
২৭.০৫.২০১৭
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.