অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হোক রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য

বর্তমান সংবিধান মোতাবেক ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী (একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন একটি রোডম্যাপ তৈরি করছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। বলা হয়েছে, এতে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেগুলো হল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান। এসব বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কমিশনের আলোচনার সময় নির্ধারণ করা হবে রোডম্যাপে। ১৬ মার্চ যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবহৃত চেকলিস্টের আদলে রোডম্যাপটি তৈরি করা হচ্ছে। এতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে আইন ও বিধিমালায় সংশোধনী আনার পরিকল্পনা রাখা হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হচ্ছে।
ডিসেম্বরের মধ্যে আইন ও বিধিমালা সংশোধন শেষ করার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে রোডম্যাপে। এছাড়া চলতি বছরেই নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং ৩০০ আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টিও থাকছে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও রুটিন কাজ করবে কমিশন। ওই বছরের ডিসেম্বরের শেষদিকে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও একজন কমিশনারের বরাত দিয়ে ৩০ এপ্রিল প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিগত দুটি কমিশনের কাজের ধরন বিশ্লেষণ করে রোডম্যাপ করা হয়েছে। সাবেক সচিব ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময় পেয়েছিল ১ বছর সাড়ে ১০ মাস। তারা একটি রোডম্যাপ করে কাজগুলো শেষ করেছিল। ফলে নবম জাতীয় নির্বাচনের আগে সব কাজ যেমন শেষ হয়েছিল, তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ওই কমিশনকে তেমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এরপর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশনের সময় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কোনো রোডম্যাপ ছিল না। বড় দুটি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কমিশনের রোডম্যাপ তৈরির উদ্যোগে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রধান অংশীজন হল রাজনৈতিক দল।
তাই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ হওয়া জরুরি। এর মাধ্যমে দলগুলোর নির্বাচনী ভাবনা ও ইসির কাজের বিষয়ে কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া সম্ভব। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তার দল সংকট সমাধানে আলোচনায় বিশ্বাস করে। সংলাপ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। সাধারণ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে জনগণ ভয়ভীতি ছাড়া এবং প্রভাবমুক্ত থেকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ফলে গঠিত সংসদে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। তা না হলে যে সংসদ গঠিত হয় তাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিগত চার দশকের বেশি সময়কালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোর মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কয়েকটি নির্বাচন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজিত হওয়ার কোনো নজির নেই। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে অনেকটা ওই দলের একক অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাই বর্তমান কমিশনকে একটি অংশগ্রহণমূলক,
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত গণতন্ত্রকে সুস্থ ও সবল করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। সেদিক থেকে কমিশনের নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি রোডম্যাপ তৈরি করে আরপিও সংশোধনসহ নির্ধারিত কাজগুলো সম্পন্ন করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আরপিওর অধিকতর সংশোধনসহ বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ ওই কমিশন নিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ পদ্ধতি) আইন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন ও বিধিমালা এবং নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয় (জনতহবিল) আইন। আরপিও অধিকতর সংশোধনসহ উল্লিখিত আইনগুলোর খসড়ার ওপর মতামত প্রদানের জন্য কমিশন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসব বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় যোগদানের সুযোগ হয়েছিল আমার। কমিশন ওইসব আলোচনার আলোকে আইনগুলোর খসড়া তৈরি করলেও সেগুলো শেষ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ পদ্ধতি) আইন এবং নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয় (জনতহবিল) আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তখনও ছিল, এখনও আছে। কমিশন সম্প্রতি পুনর্গঠিত হওয়ায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ পদ্ধতি) আইন’টির প্রণয়ন আগামী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে কালো টাকার প্রভাব থেকে নির্বাচনকে মুক্ত করতে এবং নির্বাচনী ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনতে ‘নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয় আইন’ প্রণয়ন করা দরকার।
রোডম্যাপে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয় (জনতহবিল) আইনও রোডম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি কমিশন বিবেচনা করতে পারে। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের মতামতের আলোকে এটির খসড়া চূড়ান্ত করা যেতে পারে। বর্তমান কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল জনগণের আস্থা অর্জন করা। এতে তারা ইতিমধ্যে কিছুটা সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এখন তাদের পরবর্তী এজেন্ডা হবে মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এজন্য কমিশনের কাজ হবে সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। এ কাজটি হবে কমিশনের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কারণ তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট এবং জোটের বাইরের ৯টি সমমনা দল দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে অনেকটা একদলীয় নির্বাচনে স্বল্পসংখ্যক কয়েকটি আসন বাদে বাকি সব আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। বিশ্বে সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ বহাল রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নজির না থাকলেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শাসক দল আওয়ামী লীগ সংসদ বহাল রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করেছে। ফলে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় জাতীয় সংসদের মোট আসনের কমবেশি ৯০ ভাগ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা (তাদের মধ্যে অনেকে মন্ত্রীও হয়েছেন) ক্ষমতায় থাকবেন। তাছাড়া কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন নিরপেক্ষভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত/ মনোনীত প্রার্থীরা এসব নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করেন। তারা দলীয় নীতিনির্ধারকদের ইঙ্গিতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে যে পিছপা হবেন না, তা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়। এসব বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে কমিশনকে সব দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির এজেন্ডায় জয়ী হতে হবে। তাহলেই বিএনপিসহ সব নিবন্ধিত দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে কমিশনের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাস্তবে নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য,
নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে শুরু হওয়া প্রশাসনে দলীয়করণ বর্তমানে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানেন, যে সরকার ক্ষমতায় আসবে সে সরকারই তাদের রক্ষা করাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে। তাই নির্বাচন কমিশন কোনো শাস্তি দিলেও শেষমেশ তা কার্যকর করতে পারবে না। সঙ্গত কারণে প্রশাসনের যারা বেনিফিশিয়ারি তারা নিজেদের স্বার্থেই সরকারের পরিবর্তন চাইবেন না। তাই কমিশনের কাজ হবে মাঠ প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষ থাকতে উদ্বুদ্ধ করা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করে মাঠ প্রশাসন যে সুনাম অর্জন করেছিল, তা তাদের স্মরণ করে দিতে হবে। তাদের সে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। এটা করতে পারলে কমিশনের পক্ষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পথে কোনো দলবাজ কর্মকর্তা বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার দিয়েছেন, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সব শেষে যা বলতে চাই তা হল, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন নিরপেক্ষভাবে তাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলে সফলতা অনিবার্য। এজন্য ক্ষমতাসীন দল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যসব দলের পূর্ণ সহযোগিতা কমিশনের দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে শাসক দলের সহযোগিতা কমিশনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে এবং জনগণের আশা সরকার তা কমিশনকে দেবে। সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে কমিশন একটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবে- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.