এক বছরে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা পাচার

অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে টাকা পাচার। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ২৫৭ কোটি ডলার (১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। সোমবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। পাচার হওয়া এই অর্থের পরিমাণ দেশের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় সমান। আর এই অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। জিএফআইর তথ্য মতে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণ। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৫৩ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। প্রতি বছরই এই পাচারের হার বাড়ছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৩ সালে পাচার হয়েছে ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৪৯টি দেশের অর্থ পাচারের তথ্য উঠেছে। আলোচ্য সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হওয়ায় টাকা পাচার বেড়েছে। এছাড়া দুর্নীতিও টাকা পাচারের অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। বিপরীতে ২ বছর ধরে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ধারণা করা হচ্ছে, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে। অর্থাৎ যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে, তা ফেরত আনা খুব কঠিন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, জিএফআই বিশ্বের সব দেশের রিপোর্ট করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও নাম এসেছে। এক্ষেত্রে রিপোর্টের ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা পাচার করা কিছু অর্থ ফেরতও এনেছি। তিনি বলেন, জিএফআইর তথ্যের সূত্রের ব্যাপারে আমাদের জানা নেই। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য পাওয়া গেলে আমরা পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) আছে। ফলে টাকা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। টাকার অংকে যা ৮২ লাখ কোটি টাকা। আর ২০১৩ সালে পাচার হয়েছে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার, যা টাকার অংকে দাঁড়ায় ৮৮ লাখ কোটি টাকা। প্রতি ডলার ৮২ টাকা ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। জিএফআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর গড়ে ৬৫১ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার অর্থ পাচার হয়েছিল। তিন বছরের ব্যবধানে এই অর্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬৬ কোটি ডলারে। গত দশ বছরে ৬ হাজার ৫১০ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। জিএফআই এবার অর্থ পাচারের হিসাবে একটু পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে উঠে এসেছে। পণ্য বা সেবা আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, পরের বছর ৪০৯ কোটি ডলার পাচার হয়। ২০০৮ সালে পাচারের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী দু’বছর অর্থ পাচার কিছুটা কমে আসে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়। ২০১২ সালে ৭২২ কোটি। ২০১৩ সালে এই পাচার বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬৬ কোটি ডলার এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালে তা বেড়ে ১ হাজার ২৫৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। এর আগের বছরের চেয়ে পাচার বেড়েছে ২৯১ কোটি ডলার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচারে ভারতের পরের অবস্থানে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে দেশটি থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ ১০ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। পাকিস্তান ১ হাজার ১৪৮ কোটি, শ্রীলংকা ৫৪০ কোটি এবং নেপাল ১৩১ কোটি ডলার। জিএফআইর রিপোর্ট অনুসারে ২০১৪ সালে চীন থেকে পাচার হয়েছে ৮৫ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাশিয়া ১৯ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার, মেক্সিকো ১২ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার, ভারত ১০ হাজার ১১৬ কোটি ডলার, মালয়েশিয়া ৫ হাজার ৫৪২ ডলার, ব্রাজিল ৫ হাজার ৩৬ কোটি ডলার, থাইল্যান্ড ৪ হাজার ৬৫৮ কোটি ডলার, ইন্দোনেশিয়া ৪ হাজার ৮০৭ কোটি ডলার এবং নাইজেরিয়া ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলার। শিল্প বিনিয়োগে মন্দার মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির নামে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হচ্ছে। কেননা যেভাবে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, সেভাবে শিল্পের উৎপাদন বাড়েনি। তাহলে আমদানি করা ওইসব শিল্প উপকরণ কোথায় গেল? কৃষিতে কয়েক বছর ধরে বাম্পার ফলন হওয়ার পরও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে চাল আমদানি বেড়েছে।
সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তারপরও কেন চাল আমদানি হচ্ছে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, শিল্পের যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের বক। এতে শিল্পের কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়া রফতানি এলসি (ঋণপত্র) এবং ক্রয়চুক্তির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ধরা পড়েছে। গত তিন বছরে মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশির জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। এর আগে মালয়েশিয়া সরকারের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ বাংলাদেশ। যদিও দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। জানা গেছে, গত ১০ বছরে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন- এরপরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কিভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হল। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল হোসেন জানান, নিশ্চিত ওইসব টাকা পাচার করা হয়েছে। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেই মালয়েশিয়ায় টাকা নেয়ার। তারপরও টাকা গেছে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, এই টাকা পাচার হয়েছে। কানাডায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন এমন একটি এলাকার নাম হয়েছে বেগমপাড়া। বিশেষ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা ওখানে টাকা পাচার করে সম্পদ গড়ে তুলেছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হংকংয়ে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে। সেখানে তারা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন। প্রসঙ্গত, জিএফআই হল ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা। যারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে থাকে। একই সঙ্গে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে প্রতি বছর তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

No comments

Powered by Blogger.