বাংলাদেশে নৈরাজ্য

বাংলাদেশ যে এখন একটা নৈরাজ্যের দেশে পরিণত হয়েছে এ বিষয়ে কারও, এমনকি শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশেরও কোনো দ্বিমত বাস্তবত নেই। এটা তাদের মুখপাত্রদের দৈনন্দিন বক্তব্য থেকও পরিষ্কার। মাত্র কয়েকদিন আগে শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রামে নিজেদের এক দলীয় সভায় তার দলের লোকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, তারা যেভাবে টাকা-পয়সা বানাচ্ছেন তাতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকলে তাদেরকে নিজেদের অর্জিত টাকা-পয়সা নিয়ে পলায়ন করতে হবে। কোনো একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্য সভায় যে নিজেদের দলের লোকদের উদ্দেশে একথা বলতে পারেন, এটা এক অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিতে কিছুই অসম্ভব নয়!! বাংলাদেশে বর্তমানে আধিপত্যে থাকা ব্যবসায়ী বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের চরম লুটপাট, দুর্নীতি ও দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে সারা দেশে যে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার ফলে এদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, জনগণের নিরাপত্তা- সব ক্ষেত্রেই এক চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে। এ অবস্থা এখন হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকে ব্যবসায়ী বুর্জোয়াদের একটানা আধিপত্য যেভাবে চলে আসছে, এটা হল তারই অপ্রতিরোধ্য পরিণতি। এ মুহূর্তে ঢাকায় বনানীর এক হোটেলে দু’জন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সব মহলে হৈ চৈ হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রতিদিনই এর ওপর রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্ষণকারী যুবকের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হচ্ছে, ধর্ষকের পিতা যেভাবে চরম নির্লজ্জতার সঙ্গে ছেলের ধর্ষণকাণ্ড সমর্থন করে পুলিশের কাছে বক্তব্য দিয়েছে, এমনকি সে নিজেও তার ছেলের মতোই একজন ধর্ষণকারী বলে জানিয়েছে, তাতে পরিস্থিতি কোন্ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এটা বোঝার কোনো অসুবিধা নেই। এর বিরুদ্ধে নানা ধরনের নারী সংগঠনসহ অন্যকিছু সংগঠন বক্তৃতা-বিবৃতি, মিছিল, মানববন্ধন করছে। কিন্তু এ ধরনের প্রতিবাদ যে নিষ্ফল হয় সেটা এর আগে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যেই দেখা গেছে। এর মূল কারণ, এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তার কিছুই দেখা যায় না। যারা এসব অপরাধ করে তারা শাসক শ্রেণীরই খুব প্রভাবশালী অংশ এবং তারা নানাভাবে পুলিশ ও সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থার ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছে। সেটা না হলে শুধু বনানীর হোটেলের ধর্ষকই নয়, তার পিতাকেও তার উপরোক্ত বক্তব্যের জন্য গ্রেফতার করা হতো। বনানীর এ ঘটনার পর গ্রেফতারকৃত ধর্ষক জানিয়েছে, তার পিতা তাকে প্রতিদিন দুই লাখ টাকা হাতখরচ দিয়ে থাকে! অর্থাৎ এই দুর্বৃত্ত যুবকটির মাসিক হাতখরচা হচ্ছে ৬০ লাখ টাকা! যেখানে একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি হল পাঁচশ’ থেকে হাজার টাকা! বাংলাদেশের ‘উন্নয়নের’ ক্ষেত্রে এই উন্নয়নের ফায়দা সামান্যতম গণতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তে কারা লুটপাট করছে, এর থেকে সেটা বোঝা কোনো গর্দভবুদ্ধির লোকের পক্ষে পর্যন্ত অসুবিধা নেই। কাজেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা বলে মুখে খৈ ফোটান, তাদের কথার অসারতা ও ভুয়া চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহের কারণ নেই। উপরোক্ত ধর্ষকের পরিবার স্বর্ণ ব্যবসায়ী। তারা আপন জুয়েলার্স নামে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। ঢাকায় তাদের প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি শাখায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ সাড়ে তিন মণের বেশি সোনা জব্দ করেছে। স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং সরকারের শুল্ক বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ১০ বছর ধরে কোনো সোনা আমদানি করা হয়নি।
অথচ এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে সোনার কারবার অবাধে চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বছরে মুনাফা করছে! এর থেকেই বোঝা যায় এখন বিপাকে পড়ে পুলিশ ও কাস্টমস বিভাগ, ন্যাশনাল ব্যুরো অব রেভিন্যু (এনবিআর) ইত্যাদির এক ধরনের তৎপরতা ও নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এতদিন তারা কোথায় ছিলেন? কী করছিলেন? সোনা যেখানে আমদানিই হচ্ছে না, সেখানে সোনার রমরমা ব্যবসা দেশে চলতে থাকলেও কেন এই দুর্নীতি তাদের চোখে পড়েনি? সোনা চোরাপথে আমদানির বিষয়ে কি তারা এতদিন কিছুই জানতেন না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার? এই চোরাচালান ও সোনার অবৈধ ব্যবসার জন্য শুধু কি স্বর্ণ ব্যবসায়ীদেরই দায়ী করা যাবে, নাকি তার দায় শুল্ক বিভাগ, এনবিআর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপরও বর্তায়? সেটা হলে তাদেরকেও কি দেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না? অপরাধের দায় থেকে কি তারা মুক্ত থাকবে? এবং মুক্ত থাকলে কেন ও কী কারণে তারা মুক্ত থাকবে? এর ফলে কি দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি তৈরি করা এবং তার অবনতি ঘটনা হচ্ছে না? কিন্তু শুধু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাই নয়, সারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এভাবেই হচ্ছে। যে চোরাকারবার ও চোরাচালানি ১৯৭২ সাল থেকে ধনসম্পত্তি অর্জনের প্রধান উপায় হিসেবে দেখা দিয়েছিল, তার কোনো পরিবর্তন আজ পর্যন্ত হয়নি। চোরাকারবার, চোরাচালানি, চুরি-ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট, ভূমিদস্যুতা থেকে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সর্বত্র একই ব্যাপার। গত ১৮ মে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেছেন, উন্নয়নের নামে যে ব্যয় হয় তার ৪০ শতাংশ ঠিকমতো খরচ হয় এবং বাকি ৬০ শতাংশ চুরি হয়ে যায়। এই চুরি কারা করে? বাংলাদেশে এভাবে যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে, উন্নয়নের যে জয়যাত্রা চলছে, তার ফলে সরকারি তহবিলে যে পরিমাণ রাজস্ব জমা হওয়ার কথা তার অর্ধেকও জমা হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করছেন, এবার তিনি চার লাখ কোটি টাকার ওপর বাজেট পেশ করে জনগণকে চমক লাগিয়ে দেবেন! কিন্তু এই চমক লাগানো বাজেটে ঘাটতি থাকবে। এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য তাদের সরকার নির্দয়ভাবে জনগণের ওপর নানাভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর ধার্য করে তাদের গলায় হাত দেবেন এবং পেটে লাথি মারবেন। কিন্তু যারা দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ী তাদের পকেটে হাত দেয়ার ক্ষমতা এ সরকারের নেই। কারণ সরকারের ওপর ব্যবসায়ীদের আধিপত্য প্রায় নিরঙ্কুশ! এ কারণে সব ধরনের ব্যবসায়িক দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, চোরাচালানি ও চোরাকারবারের বিরুদ্ধে তাদের করার কিছুই নেই। যারা রক্ষক তারা যেভাবে বাংলাদেশে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে তাতে এটাই স্বাভাবিক। একদিকে এই অবাধ লুটপাট ও নৈরাজ্য এবং অন্যদিকে জনগণের ওপর চরম সরকারি নির্যাতন বাংলাদেশের জনগণকে এমন এক সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে, যা তারা পাকিস্তানবিরোধী ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কল্পনাও করেননি। কিন্তু যে পরিস্থিতি তারা কল্পনাও করেননি, সেই পরিস্থিতির মধ্যেই তারা এখন নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। ২০.০৫.২০১৭
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.