বদরুলের যাবজ্জীবন খাদিজার শুকরিয়া by ওয়েছ খছরু

সিলেটে খাদিজা আক্তার নার্গিসের ওপর হামলাকারী বদরুল আলমকে ৩২৬ ধারায় সর্বোচ্চ সাজাই দিলেন আদালত। মাত্র ৯ কার্য দিবসে সমাপ্ত করলেন বিচার। ঘোষিত রায়ে বদরুলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
গতকাল দুপুরে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচার আকবর হোসেন মৃধা এই রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ের বদরুলকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণাকালে বদরুল কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। মামলার রায়ে শুকরিয়া প্রকাশ করেছেন হামলার শিকার হওয়া কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস ও তার পরিবারের সদস্যরা।
আর্ন্তজাতিক নারী দিবসে এমন রায়কে যুগান্তকারী রায় বলে আখ্যায়িত করেছেন আইনজীবীরা। তবে- মামলার রায়ে অসন্তুষ প্রকাশ করেছেন বদরুলের আইনজীবী। জানিয়েছেন, তিনি ন্যায় বিচার পাননি। উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। এদিকে নারী দিবসের রায় শোনার পর খাদিজা প্রত্যাশা করেছেন তার মতো যেন আরো কোনো মেয়ের উপর এরকম ঘটনা না ঘটে। গেলো ২৬শে ফেব্রুয়ারি সিলেট মুখ্যমহানগর হাকিম সাইদুজ্জামান হিরোর আদালতে কলেজ ছাত্রী খাদিজার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। এরপর ১লা মার্চ ওই আদালত থেকে মামলাটি স্থানান্তরিত করা হয় সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আদালতে। ওইদিন মহানগর দায়রা জজ আদালতে নথিপত্র দেখার পর গত রোববার যুক্তিতর্ক উপস্থানের তারিখ নির্ধারণ করেন। এরপর আদালতে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা প্রায় সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আদালতে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এক দিনেই যুক্তিতর্ক সমাপ্ত করার পর বিশ্ব নারী দিবসে ৮ই মার্চ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত।
গতকাল খাদিজার মামলার রায় ঘোষণা উপলক্ষে সিলেটের আদালতপাড়ায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আদালত এলাকার সব ক’টি প্রবেশ পথেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এই নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সকাল ১০টার দিকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রিজন ভ্যানে করে আদালত প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয় বদরুলকে। তাকে প্রথমে রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে বদরুলকে আরেক আসামির সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হয়। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আদালতে হাজির করার পর বদরুল শান্ত ছিল। কোনো কথা বলেনি। সে মাথা নিচু করে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা আলোচিত এ মামলার রায় পড়া শুরু করেন। রায়ের এক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণে আদালত জানান, প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বদরুল এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আদালত রায়ে বদরুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। এছাড়া তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ২ দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। এদিকে রায় ঘোষণার পর কিছুটা উগ্র হয়ে উঠেছিল বদরুল। আদালত থেকে তাকে যখন প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয় তখন সে বলে উঠে- ‘তার উপর ইনজাস্টিজ হয়েছে। সে আপিল করবে। এবং ন্যায় বিচার পাবে।’
এদিকে, রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। তিনি জানান, আদালত বদরুলকে যাবজ্জীবন দণ্ড প্রদানের পাশাপাশি জরিমানাও প্রদান করেছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন এই রায়ে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বলেন, এই রায় যুগান্তকারী রায়। আদালত সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই রায় ঘোষণা করেন। এতে করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সিলেটের আদালত আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে বলে জানান তিনি। আর খাদিজার পরিবারের আইনজীবী একে শিবলীও রায়কে মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, এই রায়ে সবাই খুশি। এতে করে খাদিজা ও তার পরিবার ন্যায় বিচার পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে, ঘোষিত রায়ে অসন্তুষ প্রকাশ করেছেন বদরুল আলমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাজ্জাদুর রহমান। তিনি বলেন- এখনও তিনি রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাননি। তবে, তিনি প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় পাননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানান তিনি। সিলেটের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রাশিদা সাঈদা খানম রায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আদালত ঘোষিত রায়ে তারা খুশি। যুগান্তকারী এই রায় নারীদের উপর সহিংসতা রোধে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে জানান তিনি। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন আলোচিত এ মামলার বাদী ও খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস। তিনি বলেন- রায়ের আমরা খুশি ও সন্তুষ্ট। তবে আসামিরা উচ্চ আদালতে গেলে ওখানেও যাতে রায় বহাল থাকে সে আবেদন করেন তিনি। তিনি তার পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
গত বছরের ৩রা অক্টোবর সিলেট এমসি কলেজে হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস। খাদিজাকে কোপানোর দায়ে ঘটনাস্থল থেকে জনতা ও এমসি কলেজ শিক্ষার্থীরা শাহজালাল বিশ্ববদ্যিালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলমকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। বদরুলের চাপাতির আঘাতে খাদিজার মাথার খুলি ভেদ করে মস্তিষ্কও জখম হয়। খাদিজাকে কোপানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। হামলার পর প্রথমে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ও পরে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় খাদিজাকে। সেখানে ৪ঠা অক্টোবর বিকালে অস্ত্রোপচার করে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় খাদিজাকে। পরে ১৩ই অক্টোবর তার লাইফ সাপোর্ট খোলার পর ‘মাসল চেইন’ কেটে যাওয়া তার ডান হাতে অস্ত্রোপচার করা হয়। ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তিন দফা অস্ত্রোপচারের পর শরীরের বাঁ পাশ স্বাভাবিক সাড়া না দেয়ায় চিকিৎসার জন্য স্কয়ার থেকে সাভারের সিআরপিতে পাঠানো হয়। সিআরপিতে তিন মাসের চিকিৎসা শেষে ২৪শে ফেব্রুয়ারি বাড়ি ফেরেন কলেজ ছাত্রী খাদিজা। আলোচিত এ মামলার মোট সাক্ষী ছিলেন ৩৭ জন। এর মধ্যে খাদিজাসহ ৩৪ জন আদালতে তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। অপরদিকে, ঘটনার পরদিন খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৩০৭, ৩২৪ ও ৩২৬ ধারায় শাহপরাণ থানায় বদরুলকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। ওই দিনই বদরুলকে বহিষ্কার করে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বদরুলের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকে ও খাদিজা সিলেট সদর উপজেলার আউশা গ্রামের মাসুক মিয়ার মেয়ে।
রায়ে সন্তুষ্ট খাদিজাও: হামলায় আক্রান্ত হওয়া খাদিজা প্রায় ৫ মাসের চিকিৎসা গ্রহণ শেষে এখন সুস্থ। তিনি বসবাস করছেন শহরতলীর আউশা গ্রামের নিজ বাড়িতেই। গতকাল রায় ঘোষণার পর খাদিজার বাড়িতে গেলে ফাঁকা বাড়ি দেখা গেল। ভেতর থেকে কলাপসিবল ফটক লাগানো। বেলা ২টার দিকে খাদিজার বাড়ির ভেতরে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া হয়। এ সময় খাদিজা বলেন, রায়ে তিনি সন্তুষ্ট এবং খুশি। তিনি বলেন, আমি এগিয়ে যাবো। আবার পড়ালেখা শুরু করবো। ইচ্ছে পূরণে যা যা করা প্রয়োজন করবেন বলে জানান তিনি। খাদিজা বলেন, আমি সবাইকে শুকরিয়া জানাই। মিডিয়ার ভাইদের শুকরিয়া জানাই।
রায় লেখা হলো বাংলায়: খাদিজা আক্তার নার্গিস হত্যাচেষ্টা মামলার রায় বাংলাতেই লিখা হয়েছে। যুক্তিতর্কের দিনই আদালত থেকে বেরিয়ে এসে পিপি অ্যাডভোকেট মিসবাহউদ্দিন সিরাজ জানিয়েছিলেন, আদালত খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলা রায় বাংলায় লিখবেন। গতকাল অ্যাডভোকেট রাশিদা জানিয়েছেন, আদালত খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলার রায় বাংলায় ঘোষণা করেছেন। আগে রায়গুলো ইংরেজিতে ঘোষণা করা হয় জানান তিনি।
৯ কার্য দিবসে রায় ঘোষণা: স্বল্প সময়ে ঘোষিত রায়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার দৃষ্টান্ত সিলেটের আদালতের রয়েছে। আগে শিশু রাজন, আবু সাঈদ হত্যা মামলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার নজির স্থাপন করেছিলেন সিলেটের বিচারকরা। গতকাল আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। আদালতের চার্জশিট গ্রহণের মাত্র ৯ কার্য দিবসের মধ্যে ঘোষণা করা হলো আলোচিত এ হত্যাচেষ্টা মামলার রায়। আর আদালতে বিচার চলাকালে যুক্তি খণ্ডনসহ অন্যান্য বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে আসামি পক্ষের আইনজীবীকে। আইনজীবীরা জানান- দ্রুততম সময়ে রায় ঘোষণা হলেও আসামির আইনজীবীদের মতামত শোনাকে সব সময় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমনকি তিনি যুক্তিখণ্ডনেও সময় নিয়েছেন বেশি। আর দ্রুত সময়ে রায় হওয়ায় এসব ঘটনা কমে আসবে বলে জানান আইনজীবীরা।

No comments

Powered by Blogger.