মোদি ও যোগী মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

কংগ্রেস যে পাঞ্জাব দখল করবে এবং বিজেপি উত্তর প্রদেশ, এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। পাঞ্জাবে টানা ১০ বছরের শাসন অকালি দলের জনপ্রিয়তা কোন তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল, তা বোঝার জন্য পঞ্চনদের দেশে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। দিল্লি বসে নানান সূত্রে শাসক অকালি দলের ভরাডুবির খবর আসছিল। আম আদমি পার্টি ওই রাজ্যে ভোটে দাঁড়ানোয় কংগ্রেসের আরও সুবিধে হয়।
রাজ্যের গ্রামাঞ্চল এবং শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতের এই নবীনতম দলের প্রভাব অকালি দলের ভোটে ভাগ বসায়। ফলে শহরাঞ্চল ও অশিখ সম্প্রদায়ের সমর্থনে কংগ্রেস ড্যাং ড্যাং করে জিতে যায়। উত্তর প্রদেশের ভোট অবশ্য পাঞ্জাবের মতো এত সরল ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, ২২ কোটি মানুষের এই রাজ্য, যাকে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলে ডাকা হয়, বিজেপি জিতে নিল প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ৪০৩টির মধ্যে ৩২৫ আসন জেতার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, বিজেপিকে কেউই বিন্দুমাত্র বেগ দিতে পারেনি। খড়কুটোর মতো ভেসে গেল সমাজবাদী পার্টি-কংগ্রেসের জোট ও বহুজন সমাজ পার্টি। বোঝা গেল, লোকসভা ভোটের সময় নরেন্দ্র মোদির নামে যে ঝড়টা রাজ্যে বয়ে গিয়েছিল, তিন বছর পরেও তার তীব্রতা বিন্দুমাত্র কমেনি। পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল প্রকাশিত হয় ১১ মার্চ। তার দুদিন আগে ৯ মার্চ টেনিসের পরিভাষা ধার করে প্রথম আলোয় উপসম্পাদকীয়তে লিখি, উত্তর প্রদেশে ‘অ্যাডভান্টেজ মোদি’। লিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু পাঠকদের কাছে এ কথা কবুল করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, এই অ্যাডভান্টেজ যে ৬-১, ৬-১, ৬-১-এর মতো স্ট্রেট সেটে জেতা হবে, তা আমি ভাবিনি। শুধু আমি কেন, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিও সম্ভবত বুঝতে পারেননি, রাজ্যের মানুষ এমন প্রবলভাবে শুধু তাঁর জন্য বিজেপির পদ্মফুলের পাশের বোতাম টিপবে! বুঝতে পারলে প্রচারের শেষ তিনটা দিন ওইভাবে এক ডজন মন্ত্রী নিয়ে বারানসির মাটি কামড়ে তিনি পড়ে থাকতেন না। উত্তর প্রদেশের ভোট জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এবারের ভোট আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল অনেকগুলো কারণে। প্রথমত, বেশি আসনে জেতা মানে এই জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে পছন্দসই প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা সহজতর হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী বছর রাজ্যসভার যে আসনগুলো খালি হবে, সেগুলোর অধিকাংশ বিজেপি জিতে বিরোধীদের সঙ্গে শাসক দলের ফারাক কমিয়ে আনতে পারবে। তৃতীয়ত, যে সিদ্ধান্তগুলো বিরোধীদের চাপে বিজেপি নিতে পারছে না, তা সহজেই নিতে পারবে। ভোট শেষে দেখা গেল, চার রাজ্যে তারা যতগুলো আসন পেয়েছে, তা এই তিনটি লক্ষ্য পূরণে সহায়ক। বিজেপির সবচেয়ে বড় লাভ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দেশের মানুষের আস্থা যে অটুট, তা প্রমাণিত হওয়া। জাতীয় নেতা হিসেবে এ মুহূর্তে তাঁর ধারেকাছে যে কেউ নেই তা প্রতিষ্ঠিত হলো। মোদির নেতৃত্বে কংগ্রেসকে হটিয়ে বিজেপিও একমাত্র সর্বভারতীয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল। বিজেপি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে নরেন্দ্র মোদির ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার ডাক প্রায় সত্য হতে চলেছে। উত্তর প্রদেশে বিজেপির এই রেকর্ড জয়ের কারণ কী কী? আমার মতে, প্রথম কারণ, মোদির ভাবমূর্তি। তাঁর প্রতি দেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা এখনো নিটোল। প্রশাসক হিসেবেও তিনি দুর্নীতিমুক্ত সরকার উপহার দিতে সফল। মানুষ দেখছে, তিন বছরের রাজত্বে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে একটাও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। দ্বিতীয় কারণ, উত্তর প্রদেশের জাতপাতের বিভাজনকে দারুণভাবে ম্যানেজ করা। দলিত মানেই মায়াবতীর অনুগত এবং অনগ্রসর মানেই মুলায়ম-অখিলেশের তাঁবেদার, দীর্ঘ কয়েক দশকের এই ধারণা বিজেপি ভেঙে দিতে পেরেছে। ঘরের মধ্যে ঘরের মতো তারা গড়ে তুলেছে নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠী। সমাজবাদী শাসন এক অর্থে যাদবদের শাসন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক যেমন দলিত উন্নয়ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল শুধুই জাটভ গোষ্ঠীর (মায়াবতীর জাত) অগ্রগতি। এই দুই জাতকে বাদ দিয়ে অন্য অনগ্রসর ও অন্য দলিতদের মধ্যে তিন বছর ধরে বিজেপি তার প্রভাব বিস্তার করেছে। লোকসভার মতো বিধানসভাতেও তাই তার সুফল তারা পেল। বিজেপির বিপুল জয়ের তৃতীয় কারণটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভোট বিভাজন। বিজেপি একজন মুসলমানকেও এবার প্রার্থী করেনি, মায়াবতী প্রার্থী করেন ৯৯ জনকে। অখিলেশ-রাহুল না মায়াবতী—কাকে সমর্থন করবে সেই ধন্দে পড়ে মুসলমান ভোট গোটা রাজ্যেই বিভাজিত হলো। রাজ্যের শিয়া সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ অটল বিহারি বাজপেয়ির সময় থেকেই বিজেপির সমর্থক। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু তিন তালাকের বিরোধিতা করায় বহু মুসলমান নারী মোদির জন্য বিজেপিকে এবার ভোট দিয়েছেন বলে প্রচার চলছে। নির্বাচন কমিশনের কোনো তথ্যে অবশ্য এখন পর্যন্ত এই প্রচারের পক্ষে সমর্থন মেলেনি। বিজেপি উত্তর প্রদেশ শাসন করেছে ১৫ বছর আগে। কংগ্রেস এই রাজ্য হারিয়েছে ২৭ বছর আগে। এই রাজ্যের ভোটার কেন্দ্র ও রাজ্যে কংগ্রেসের শাসন কেমন তা জানেন। মুলায়ম ও মায়াবতীর শাসন কেমন তা-ও জানা। অজানা বলতে দুটি বিষয়। পারিবারিক বাঁধন-ছেঁড়া অখিলেশ ও রাহুলের ওপর ভরসা রেখে তাঁদের রাজ্য শাসন করতে দেওয়া ছিল একটি পছন্দ, অন্য পছন্দ মোদির ওপর ভরসা রেখে তাঁর দলকে সুযোগ দিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপির শাসনের স্বাদ নেওয়া। উত্তর প্রদেশের মানুষ দ্বিতীয় পছন্দকেই আঁকড়ে ধরেছে। এখানেও মোদি হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রধান আকর্ষণ। নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর আস্থাভাজন সভাপতি অমিত শাহ শেষ পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যাঁকে বেছে নিয়েছেন, সেটাও একটা দুর্দান্ত চমক। শুধু চমকই নয়, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তির কাছে এটা এক বিরাট ধাক্কা। ৪৪ বছরের গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের গোরক্ষপুর কেন্দ্র থেকে পাঁচবারের নির্বাচিত সাংসদ। ‘লাভ জেহাদ’-এর বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম গলা উঁচিয়েছিলেন। শাহরুখ খানকে ধমকে ছিলেনও তিনিই।
বরাবর তাঁর গরম-গরম কথা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এ হেন আদিত্যনাথকে মোদি-শাহ জুটি বেছেছেন নাকি সংঘ পরিবারের এই সিদ্ধান্ত গিলতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন, এ নিয়ে আপাতত শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। সত্যি বলতে কি, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আদিত্যনাথের নাম ভোটের আগে ও পরে কোনো প্রচারমাধ্যমে একবারের জন্যও আসেনি। এখন তিনিই শিরোনাম। আবার সেই টেনিসের পরিভাষা ধার করে বলা যায়, ‘ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি’ পেয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেন! আদিত্যনাথের উত্থানে যাঁরা বিস্মিত, আমি তাঁদের দলে নই। কারণ, আমার ধারণা, অনেক ভেবেচিন্তেই বিজেপি তাঁকে পছন্দ করেছে। ঠিক যে যে কারণে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাছা হয়েছিল, আদিত্যনাথকেও বাছা হয়েছে ঠিক সেই কারণেই। মোদির মতোই আদিত্যনাথ সুশাসক। গোরক্ষপুর থাকলে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা তাঁর বাড়িতে জনতা দরবার হয়। দলে দলে মানুষ আসে নানা রকমের সাহায্যের জন্য। হিন্দু-মুসলমান সবার জন্য তাঁর বাড়ি ও আশ্রমের দরজা খোলা। আশ্রমের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছেন মুসলমানেরা। আদিত্যনাথের একটা চিঠিতেই সমস্যার সুরাহা হয়ে যায়। মোদির মতো তাঁরও সাংগঠনিক শক্তি প্রবল। মোদি যেমন সংসারী নন, সন্ন্যাসী হওয়ায় আদিত্যনাথও সর্বত্যাগী। কাজেই স্বজন-পোষণ বা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার বাহ্যিক কোনো কারণ তাঁর নেই। মোদির মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার যে ক্ষমতা রয়েছে, সেই ক্ষমতা আছে আদিত্যনাথেরও। মোদির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট মিল।
সফল হওয়ার যে তাগিদ ও তাড়না মোদির মধ্যে লক্ষ করা গেছে, আদিত্যনাথের মধ্যেও তা পরিলক্ষিত। মোদির মতো তিনিও কড়া ধাতের রাজনীতিক। একবগ্‌গা। ‘টাফ নাট’। উত্তর প্রদেশে বিজেপির যেসব ‘অ্যাজেন্ডা’ রয়েছে (রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা যার অন্যতম), সেগুলো ঠিকঠাক উতরোতে গেলে আদিত্যনাথের মতোই একজন শক্তপোক্ত নেতার প্রয়োজন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোট মাথায় রেখে তাঁকে বেছে নিতে বিজেপি নেতৃত্ব ও সংঘ পরিবার তাই দেরি করেনি। আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার। ২০০২ সালে গোধরার বদলায় গুজরাট দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হওয়ার সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। সম্পত্তিহানির হিসাব-নিকাশ নেই। কিন্তু তার পর থেকে আজ পর্যন্ত গুজরাটে একবারের জন্যও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। মোদির দল সেখানে আজও ক্ষমতাসীন। ভালোবাসা ভক্তি ও ভয়—দুই দিক থেকেই আদায় করা যায়। কে বলতে পারে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদিত্যনাথের অভিষেকের পেছনে এই মানসিকতা কাজ করেনি? দেশে কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠায় এবারের ভোট যথেষ্ট সহায়ক। বিপক্ষ ছত্রখান ও হীনবল। মোদিকে রুখতে তারা জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে। জোট হতেও পারে। কিন্তু কেন্দ্রে জোট সরকারের ইতিহাস মোটেই আহামরি কিছু নয়। বারবার জোট হয়েছে, ভেঙেছেও। কারণ, কোনো জোটই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে গড়ে ওঠেনি। গড়া হয়েছিল তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে। মোদির বিজেপিকে রুখতে তেমন জোট হলে দেশের মানুষ তাকে আমল দেবে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় থাকবেই। দুর্নীতি কল্কে না পেলে ও আর্থিক পরিস্থিতি রসাতলে না গেলে ২০১৯-এ বিজেপির রথের সারথি নরেন্দ্র মোদিকে কিন্তু রোখা কঠিন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.