ঢাকায় ইয়াহিয়ার নৈশবিহার

ইয়াহিয়া খান ছিলেন আরশাদ সামি খানের বস। এ কারণে তিনি তাঁর অনেক ‘দুষ্কর্ম’ গোপন করেছেন। সামি খান তাঁর বইয়ে ইয়াহিয়াকে একজন প্রেমিক ও রসিক পুরুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু যাঁরা পাকিস্তানের অন্দরমহলের খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন ইয়াহিয়া খান কী চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তিনি প্রেমিক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর প্রেমিকার সংখ্যা ছিল অগুনতি। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অনেকের লেখায় এসব উঠে এসেছে। পাকিস্তান পুলিশের সাবেক আইজি সরদার মুহাম্মদ চৌধুরী দ্য আলটিমেট ক্রাইম-এ লিখেছেন, ‘স্বয়ং প্রেসিডেন্টের ছিল মদ ও নারীভোগের নেশা। আর তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্নেল ছিলেন সমকামী...। বারবনিতা আর বেশ্যার দালালদের প্রেসিডেন্ট হাউসে যাতায়াত ছিল অঢেল ও অবাধ। তাঁদের কজন আবার বেশ হাই স্ট্যাটাস ভোগ করতেন। আকলিম আখতার, মিসেস কে এন হোসেইন ও লায়লা মুজাফফরের মর্যাদা ছিল সর্বোচ্চ। মোহময়ী রমণীদের পাল ঘুরে বেড়াত ভবনের সর্বত্র। তাঁরা ধূমপান করতেন, মদ পান করতেন, নেচে-গেয়ে হেলেদুলে হই-হুল্লোড় করতেন।’ ১৯৭১-এ ঢাকায় মার্কিন মিশনের প্রধান আর্চার কে ব্লাড, যিনি নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্রের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন, দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, ‘১৯৪৪ সালে ইয়াহিয়া ছুটিতে বাড়িতে এসে বিয়ে করেন এক আর্মি অফিসারের মেয়েকে।
তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ে। দিনে দিনে ইয়াহিয়া বিখ্যাত হয়ে ওঠেন এক নারীবাজ হিসেবে। তিনি তাঁর এই কীর্তি গোপন করার চেষ্টা করতেন না। নাইট ক্লাবে তাঁর রক্ষিতাকে বগলদাবা করে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হতেন। আমাকে কয়েকজন অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিবাহিত মহিলার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলা হয়েছিল, এরা সবাই ইয়াহিয়ার রক্ষিতা।’ কথাশিল্পী আনিসুল হক ইয়াহিয়ার প্রেম ও লাম্পট্য নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন জেনারেল ও নারীরা। বইয়ের এক জায়গায় আছে, ‘রানি ইয়াহিয়াকে কোট পরালেন। তাঁর টাইয়ের নট বেঁধে দিলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল তাঁর ফেলে আসা স্বামীর কথা। একদিন তিনি এভাবে স্বামীর টাইয়ের নটও বেঁধে দিতেন। তাঁরও দুই বাহু পাখির ডানার মতো উড়িয়ে দিয়ে তাঁকে পরিয়ে দিতেন কোট। আগাজি তাঁকে চুম্বন করলেন কপালে।’ (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৬) আরশাদ সামি খান নারী ও গানপ্রেমিক ইয়াহিয়া খানের দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। একটি ঢাকায় তাঁর রোমাঞ্চকর নৈশবিহার এবং অপরটি সংগীতসম্রাজ্ঞী নূরজাহানের গানের রেকর্ড নিয়ে। সামি লিখেছেন, ‘আমরা তখন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে ছিলাম। একদিন বিকেলে ইয়াহিয়া তাঁর অফিসের কাজ সেরে আমাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন এই সন্ধ্যায় আমার কোনো পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি আছে কি না।’
আমি বললাম, ‘না স্যার’
এরপরের কথাপোকথন এ রকম:
‘ তুমি একটি পার্টিতে আমন্ত্রিত!’
‘তাই, স্যার, কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন’—আমি মৃদু হাসলাম।
‘মি. খন্দকার’
‘কিন্তু আমি তো তাঁর কাছ থেকে কোনো আমন্ত্রণ পাইনি।’
‘তুমি আমন্ত্রণ পাওনি এ কারণে যে এখনই আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি আজ রাত নয়টায় তোমাকে নৈশভোজ ও নাচের আসরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁদের বাড়িতে নাচের জন্য সুন্দর কাঠের মেঝে আছে এবং তুমি সেখানে নাচবে।’
‘কিন্তু আমি তাঁকে ভালোভাবে চিনি না এবং তাঁর ঠিকানাও জানা নেই, স্যার।’
‘তাতে কিছু আসে যায় না। আমি তোমার পক্ষ হয়ে তাঁর আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করেছি এবং তোমার সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ঢাকায় তুমি কী গাড়ি ব্যবহার করো?’
‘আমি প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে পাওয়া একটি মাসির্ডিজ ব্যবহার করি।’
আচ্ছা, আজ রাতে ব্যতিক্রম হবে। তুমি তোমার গাড়িটা নিয়ে বের হয়ে তোমার কক্ষের সামনে থাকবে, যেখান থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনের পেছনে যাওয়া যায়। চালকের কাছ থেকে গাড়ির চাবিটি নিয়ে নাও এবং আজ রাতে চালককে ছুটি দাও। এবং সুন্দর কালো লাউঞ্জ স্যুট পরবে। তোমাকে অফিস থেকে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছে?
‘হ্যাঁ স্যার, অফিস থেকে আমাকে .৩৮ স্পেশাল মডেলের পাঁচ গুলির একটি রিভলবার দেওয়া হয়েছে, যেটি এফবিআই ব্যবহার করে।’
‘আমি আশা করি তোমার কাছে মারাত্মক অস্ত্রই আছে। এটি তোমার ভেতরের পকেটে কৌশলে সতর্কতার সঙ্গে রাখবে। এরপর সামি লিখেছেন, তাঁর এসব কথাবার্তায় আমন্ত্রণটি রহস্যজনক মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সতর্কতা কেন স্যার? আমি তো নাচের আসরে যাচ্ছি, মল্লযুদ্ধে নয়। তিনি হাসলেন এবং বললেন, ঠিক আছে। ঠিক ৯টার সময় তৈরি থাকবে এবং ৯টা ৫ মিনিটে বারান্দার সব বাতি বন্ধ করে দেবে এবং তোমার গাড়ির ছাদের বাতিও। পেছনের আসনে রাখার জন্য বিছানার চাদর নেবে। তুমি গাইডকে বিছানার চাদর দিয়ে ঢেকে দেবে। মনে রাখবে, গেটে নিরাপত্তারক্ষীদের কেউ যাতে দেখতে না পায় তুমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছ। তাহলে আমি চিৎকার দিতে থাকব যে তুমি আমাকে অপহরণ করছ।’ তিনি হাসলেন এবং বললেন, ‘এখন যাও, এবং সবকিছু প্রস্তুত করো। এবং কোনো কিছু যাতে ফাঁস না হয়।’ এরপর সামি খান যোগ করেন, ‘পরিকল্পনামতো পার্টির উদ্দেশে আমরা রওনা দিলাম। নিরাপত্তা ফটক পেরিয়ে এসে ইয়াহিয়া গাড়িতে বসলেন এবং গাড়ি আমাকে থামাতে বললেন। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সামনের যাত্রী আসনে বসলেন। তিনি চাইছিলেন যে আমি নিজেকে চালক না ভাবি।’ গাড়ি চলা শুরু করলে ইয়াহিয়া বললেন, আমাদের কোথাও থামতে হবে। আমন্ত্রণকারীর জন্য কিছু ফুল িনতে হবে। আমি নিরাপত্তাকর্মী ও প্রটোকল ছাড়া কোথাও যাইনি।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি হিসেবে ঢাকায় থাকার সুবাদে তিনি শহরের সবকিছু চেনেন। এবং চাদরে মুখের অর্ধেক ঢেকে ফুল কিনলেন; যাতে তাঁকে ফুলবিক্রেতা বা পথচারীরা না চিনতে পারেন। বন্ধুর বাসভবনে পৌঁছে তিনি ডোরবেল বাজালেন। আমি তাঁর পেছনে দাঁড়ানো। প্রেসিডেন্টকে দেখে বিস্মিত খন্দকার। ভাবলেশহীন। তিনি ভাবেননি কোনো স্কোয়াড, নিরাপত্তার গাড়ি ও মানুষ ছাড়া চুপচাপ সেখানে যেতে পারেন। গৃহকর্তাকে সম্বোধন করে ইয়াহিয়া বললেন, ‘কানু, তুমি আমাদের ভেতরে যেতে বলবে না! এ আমার এডিসি স্কোয়াড্রন লিডার আরশাদ সামি খান।’ খন্দকারের দিন তখন ভালোই যাচ্ছিল। তিনি খুবই আধুনিক ও সুন্দরভাবে সজ্জিত বাড়িতে থাকেন এবং পার্টির আয়োজনও ছিল জৌলুশপূর্ণ। আর সেখানে অনেক অভ্যাগত ছিলেন, যাঁদের অনেককে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখেছি। তাঁরা সবাই প্রেসিডেন্টকে ঘিরে দাঁড়ালেন। এবং প্রেসিডেন্টও তাঁদের অভিনন্দিত করলেন। সামি খান সেদিনের আয়োজনের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘ভারী, স্থূল শরীর সত্ত্বেও ইয়াহিয়া ছিলেন খুবই চৌকস নাচুনে। সেখানে উপস্থিত প্রায় সব নারীর সঙ্গেই তিনি নাচলেন। তবে তিনি যেকোনো ভদ্রলোকের মতোই দূরত্ব বজায় রাখলেন এবং মার্জিত রুচির পরিচয় দিলেন।
যেহেতু এটি সপ্তাহ শেষের আয়োজন ছিল, সেহেতু অনেক রাত কার্যত প্রায় ভোর পর্যন্ত চলছিল।’ সামির ভাষায়, ‘খোদাকে ধন্যবাদ যে তিনি প্রেসিডেন্টকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। কেউ তাঁর অনুপস্থিতি টের পায়নি। ওই রাতে তিনি কোনো মদ পান করেননি এবং তিনি গাড়ির পেছনের আসনে বসে আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। এবং রুমে গিয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই।’ অনেক বছর পর আবুধাবিতে এক বাঙালি নারী সেই রাতের গল্প বলেছিলেন রসিয়ে রসিয়ে। তিনি সামিকে চিনতেন না এবং অবলীলায় বলে যাচ্ছিলেন, প্রেসিডেন্ট নাকি ঢাকায় এক মেয়েবন্ধুর সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন, যঁার স্বামীর নাম কানু এবং তাঁর স্বামী ওই দিন শহরের বাইরে ছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি করাচির। একবার সেখানে এক গানের অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান তাঁর বন্ধুদের দেখিয়ে সপ্রতিভ কণ্ঠে সামি খানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পুত্র, এরা আমাকে সংগীতসম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সাম্প্রতিক পাঞ্জাবি গানের একটি রেকর্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি এটি সংগ্রহ করব।’ সমাবেশ থেকে এক বন্ধুকে ডেকে তিনি ওই গানের কলি আওড়ালেন ‘মেরি চিচি দ্য চালা মাহি লা লেয়া, কেরে যা কেহ সিকেত লাউঙ্গি’। এরপর ইয়াহিয়া বললেন, ‘পুত্র, আমি জানি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বন্ধুদের বলেছি আমার এডিসি এটি আমার জন্য এনে দিতে পারবে। তুমি কি মনে করো,
পারবে?’ তাঁর শিশুসুলভ অনুরোধে আমি হাসলাম এবং বললাম, চেষ্টা করে দেখি, ‘স্যার’। এরপর সামি খান রেকর্ডের খোঁজে বের হলেন। তিনি জানেন, অনেক আগেই করাচির দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করে সামি একজন এক অডিও ক্যাসেটের দোকানের মালিককে খুঁজে বের করলেন। এরপর তাঁকে ব্যাকুলকণ্ঠে জানানো হলো, জরুরি ভিত্তিতে তাঁর নূরজাহানের সর্বশেষ রেকর্ডটি প্রয়োজন। এ জন্য বাড়তি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিলে ওই মালিক দোকান খুলে রেকর্ড বের করে দিলেন। সামি দোকানদারকে যখন বাড়ি পৌঁছে দিয়ে প্রেসিডেন্টের বসার ঘরে ঢুকলেন তখন তাঁর কিশোরসুলভ মনটি ‘হুররে’ বলে উল্লাস করছিল।’ সামি লিখেছেন, ঘটনাটিতে রংচং লাগিয়ে এই প্রচার চালানো হলো যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মদ্যপ অবস্থায় নূরজাহানকে তাঁর সর্বশেষ রেকর্ডের গানটি গাওয়ানোর জন্য প্রেসিডেন্টের বিশেষ বিমানে করে করাচি নিয়ে আসতে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এরপর তিনি সারা রাত ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছিলেন। বিষয়টি সম্পর্কে এক বন্ধু জানতে চাইলে তাঁকে বললাম, ‘কী নির্বোধ!’ কী বাজে কথা চাউর হয়ে গেছে! মদ্যপ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নূরজাহান রাত কাটিয়েছেন!
আগামীকাল: পথের কাঁটা সরিয়ে দিলেন ভুট্টো
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.