বিজিএমইএ ভবন ভাঙা এখন সময়ের ব্যাপার

আইন না মেনে গড়ে তোলা পোশাক শিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ১৬ তলা ভবন ভাঙা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদন গতকাল রোববার খারিজ হওয়ায় রাজধানীর বহুল আলোচিত এই ভবন ভাঙার বিষয়ে আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেল। বিজিএমইএ অফিস অন্যত্র স্থানান্তরে কদিন সময় লাগবে, তা জানিয়ে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে আবেদন করতে বলেছেন আদালত। ওই দিন এ বিষয়ে আদেশ দেওয়ার দিন ঠিক করা হয়েছে। রায়ের কয়েক ঘণ্টা পর বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে নতুন ভবন নির্মাণ করে অন্যত্র যেতে সময় প্রয়োজন। তাই আদালতের কাছে আমরা তিন বছর সময় চাইব।’ গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের তিন সদস্যের বেঞ্চ রিভিউ আবেদন খারিজ করেন। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি ভাঙার আদেশ বলবৎ থাকছে। রপ্তানি বাণিজ্যের বিষয় সম্পৃক্ত থাকায় রাষ্ট্রপক্ষ এক বছর সময় প্রার্থনা করেছে। আপিল বিভাগ বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষকে ভবনটি অন্যত্র স্থানান্তরে কদিন সময় লাগবে, তা জানিয়ে আবেদন করতে বলেছেন। শুনানিতে আদালত বলেন, আজকাল দেখছি ১০০ তলা ভবন ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, র্যাংগস ভবন ভাঙতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
বিজিএমইএর আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী বলেন, সরকার জমি দিয়েছে, টাকা নিয়েছে, তবে রেজিস্ট্রি দলিল দেয়নি। একপর্যায়ে আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনারা কবে সরাবেন দরখাস্ত দিন।’ জবাবে আইনজীবী বলেন, তিন বছর। এখান থেকে ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) দেওয়া হয়, যা ছাড়া একটি গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি সম্ভব নয়। অফুরন্ত কাজ, হঠাৎ করে বন্ধ করা হলে রপ্তানি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আদালত বলেন, ২০১১ সালে রায় হয়েছে, আদালতের রায় তো মানতে হবে। এত গুরুত্বপূর্ণ হলে গুলশান-বনানীতে দুটি বাড়িতে নিয়ে নেন। আইনজীবী বলেন, আবাসিক এলাকা। আদালত বলেন, ওখানে এম্বাসিও চলছে। বিজিএমইএর পক্ষের আইনজীবী ইমতিয়াজ মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিন বছর সময়ের কথা বললে আদালত বৃহস্পতিবার লিখিত আবেদন উপস্থাপন করতে বলেন।’
মামলার বৃত্তান্ত
২০১০ সালের ২ অক্টোবর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ বিষয় নিয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ে ওই ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যানসারের মতো’ উল্লেখ করে রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেন। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে গত বছরের ৮ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়, ‘বেগুনবাড়ি খাল’ ও ‘হাতিরঝিল’ জলাভূমিতে অবস্থিত ‘বিজিএমইএ কমপ্লেক্স’ নামের ভবনটি নিজ খরচে অবিলম্বে ভাঙতে আবেদনকারীকে (বিজিএমইএ) নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। এতে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ভবনটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হলো। এ ক্ষেত্রে ভবন ভাঙার খরচ আবেদনকারীর (বিজিএমইএ) কাছ থেকে আদায় করবে তারা। রায়ে বলা হয়, ভবন নির্মাণের জন্য জলাধার আইন, ২০০০ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। এখানে তা অনুপস্থিত। বিজিএমইএ জমি খুঁজে পায়নি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য গত জুনের পর জমি খোঁজা শুরু করলেও এখনো তা পায়নি বিজিএমইএ।
তবে সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনে অন্যত্র ভবন নির্মাণ করে চলে যেতে চায় তারা। গত জুনে আপিল আবেদন খারিজ হওয়ার পর নতুন ভবন নির্মাণের জন্য তেজগাঁও শিল্প এলাকা, আগারগাঁও, পূর্বাচল ও উত্তরায় খাসজমির খোঁজখবর নেন বিজিএমইএর নেতারা। পূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমি বরাদ্দ চেয়ে আবেদনও করা হয়। তখন উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরে ৯ বিঘা আয়তনের একটি খাসজমি মেলে। তবে সেই জমি বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য নির্ধারিত বলে সেটি বাদ হয়ে যায়। পরে উত্তরাতে আরেকটি ১০ বিঘা জমি দেখেন। তবে জমিটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য এখনো জমি না পাওয়ার বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘একখণ্ড জমি পেতে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়। তাই সময় লাগছে।’ বিজিএমইএর বর্তমান ভবনটি দুই বিঘা জমির ওপর। তবে নতুন ভবনের জন্য সংগঠনটি ১০ বিঘা জমি চায়। এ বিষয়ে সংগঠনের সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘কার্যালয়ের পাশাপাশি কনভেনশন সেন্টারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ নতুন ভবন করতে চাই আমরা। তাই বড় জায়গা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘উত্তরায় না পেলে আমরা পূর্বাচলে জমি দেখব।’ ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভবনটির উদ্বোধন করেন। রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পে হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশে বিজিএমইএ ভবনে মোট এলাকা বা স্পেস ২ লাখ ৬৬ হাজার বর্গফুট। বিজিএমইএ ব্যবহার করে চারটি তলা। বাকি জায়গা দুটি ব্যাংকসহ ৪০টির মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ভবনের ফ্লোর বিক্রি করা আছে তাদের কী হবে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘আমাদের যা হবে তাদেরও একই অবস্থা হবে।’ অবশ্য বিজিএমইএর আরেক নেতা জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএর ফ্লোর কিনেছে, তারা প্রায় প্রত্যেকেই সংগঠনের সদস্য। নতুন ভবনে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে। কোন পদ্ধতিতে ভাঙা হবে? কোন পদ্ধতিতে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা হবে, তা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত।
তবে রাজউক ভবনটি বিনাশ পদ্ধতিতেই (ডিমোলিশন কন্ট্রোল) ভাঙার পক্ষে। এ পদ্ধতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি বহুতল ভবন ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। তবে এটা বেশ ব্যয়বহুল। এ পদ্ধতিতে ভাঙা হলে ভবন এলাকার চারদিকে পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের বিশেষজ্ঞ দল কাজ করবে। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ২০০৮ সালে র্যাংগস ভবন ভাঙা হয়েছিল ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে, মিস্ত্রিদের মাধ্যমে হাতুড়ি-শাবল দিয়ে। ভাঙার সময় দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন শ্রমিক মারা যান। অনেক সময়ও লাগে। তাই বিজিএমইএ ভবন ভাঙার ক্ষেত্রে ওই পদ্ধতিকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ‘ডিমোলিশন কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে ভাঙা হলে প্রচুর টাকা খরচ হয়, কিন্তু কাজ সম্পন্ন হয় দ্রুত। জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু বিবেচনায় ‘ডিমোলিশন কন্ট্রোল’ পদ্ধতিকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে তার আগে এ বিষয়ে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ওই সদস্য আরও বলেন, ‘আদালত আমাদের যদি ভাঙার নির্দেশ দেন আমরা ভাঙব। ভাঙতে যে খরচ হবে তা হিসাব করা হবে। আদালতের রায় হলো, ভাঙার খরচটা বিজিএমইএকে বহন করতে হবে। সে মতো রাজউককে ভাঙার খরচ দিতে হবে। তারা খরচ জমা দিলে আমরা কাজ শুরু করতে পারব।’

No comments

Powered by Blogger.