বিচারের জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে?

কপট রাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়িত প্রশাসন যখন একটি রাষ্ট্রকে গ্রাস করে, তখন বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত কলুষিত হয়ে যায়। জনগণকে গ্রাহ্য না করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গোষ্ঠীস্বার্থে মগ্ন হয় তারা। আর সে কারণেই ক্ষমতান্ধ মানুষ যে ডালে বসে, সেই ডালই কাটতে থাকে। পরোয়া করে না কাউকে। আর এই অসদাচরণের বিরোধিতা করলে তাকে বৈরী ঘোষণা করে হেনস্তা করতেও দ্বিধা করে না। সরকারের আইন আছে, তাকেও শায়েস্তা করতে ছাড়ে না এই অপশক্তি। জেল-জুলুম, গ্রেপ্তার-হয়রানি করে প্রতিবাদের ভাষাকে রুদ্ধ করে ক্ষমতার দাপটে। এখন তো দেশে কার্যকর বিরোধী দলও নেই, যারা সাহস করে এদের অসদাচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। তাহলে দেশের মানুষ কোথায় যাবে?
বলছিলাম নারায়ণগঞ্জের স্নিগ্ধ চেহারার সেই কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর কথা। কী অনন্যসাধারণ প্রতিভার স্ফুরণ দেখেছিলাম এই ছোট্ট কিশোরের লেখাপড়ায়! কাব্য প্রতিভায় চমকে দিয়েছিল ত্বকী সব মানুষকেই। কী ইংরেজি, কী বাংলা—সবখানেই তার দখল ছিল বলেই দুই ভাষায় তার কাব্য প্রতিভা কৈশোরেই দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিল। যঁারা ওকে দেখেননি তাঁরা, ত্বকীর লেখা পড়লেই ওকে খুঁজে পাবেন। কিন্তু পৈশাচিক শক্তির কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। ওরা নৃশংস, হৃদয়হীন, না হলে এমন একটি নিষ্পাপ কিশোরকে কেন অপহরণ করল, যখন সে পাঠাগারে পড়তে যাচ্ছিল? তাহলে কেন নির্মমভাবে হত্যা করা হলো একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর টর্চার সেলে? সে হত্যার বিবরণ উদ্ঘাটিত হয়েছিল র্যা বের তদন্ত প্রতিবেদনে। যে প্রতিবেদন র্যা বের কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেছিলেন। এই যে তদন্তকারী দল তাদের খোঁজখবরের ভিত্তিতে যথাস্থানে গিয়ে একাধিক টর্চার সেল দেখতে পেয়েছিল এবং ত্বকীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ তাতে লিপিবদ্ধ করে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু বারবারই কোনো অদৃশ্য শক্তির নির্দেশে আদালতে সে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো না। আজ চার বছর হতে চলল, কেন সেই জনসমক্ষে প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন আজও আদালতের টেবিলে পৌঁছাল না। এমতাবস্থায় ত্বকীর বাবা একজন লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, দক্ষ সংগঠক, সচেতন রাজনৈতিক প্রগতিশীল ধারা অনুসারী রফিউর রাব্বি এবং ত্বকী হত্যায় সংক্ষুব্ধ বেশ কিছু জনপ্রতিনিধি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুবিচার চেয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, বিচার হবে। আজ না হোক কাল, কাল না হলে পরশু। কিন্তু চার বছরেও ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি।
আমরা কি জানতে পারি কেন ত্বকী হত্যার বিচার হচ্ছে না? এটা ব্যথিতজনের প্রশ্ন। যেখানে আমরা কিশোর রাজন-রাকিবের হত্যার বিচার সাত-আট মাসের মধ্যে করতে দেখলাম; সেখানে ত্বকী হত্যার বিচার কেন চার বছরে হলো না? এই সরকারের আমলেই সিলেট ও খুলনার দুই পৈশাচিক হত্যার বিচার যদি সাত মাসে হতে পারল কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যার বিচার কেন হলো না? কোনো অগ্রগতি নেই এ মামলার! রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের ‘গডফাদার’ পরিবারের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, তোলাবাজি এবং ক্ষমতার দম্ভ দেখানো মানুষদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। আর তাদের বাঁচাতেই কি ত্বকী হত্যার বিচারকাজ মাঝপথে থেমে গেল? রাব্বি জনগণের পক্ষ নিয়ে নাগরিক কমিটি, নাগরিক পরিষদ গঠন করে গডফাদারদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং গডফাদাররা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও সমর্থন পেলেন না। পেলেন শামীম ওসমান। আইভী আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন। নির্বাচন শেষে দেখা গেল শামীম ওসমানকে পরাজিত করে আইভী লক্ষাধিক ভোটে জিতে প্রমাণ করলেন ‘নাগরিক কমিটি’র সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। যখন আইভী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তিনি প্রথম বলেছিলেন, ‘জানতাম, তুমিই জিতবে।’ ...যাহোক, ওই নির্বাচনে আইভীর পক্ষে ‘নাগরিক কমিটি’ এবং রফিউর রাব্বিরাই ছিলেন। সেটাই বুঝি কাল হলো। সে কারণেই কি প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও ত্বকী হত্যার বিচার হলো না? র্যা বের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ত্বকীকে অপহরণ করে টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর অজ্ঞান হওয়ার পর গলাটিপে হত্যা করা হয়েছিল। রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করার জন্যই নিষ্পাপ অনন্য মেধাবী কিশোর ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। সাহসী রফিউর রাব্বি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সমবায়ে ‘সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ’ গড়ে তুললেন।
নারায়ণগঞ্জের সচেতন প্রগতিবাদী মানুষ গণবিরোধী ওই চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললেন। নারায়ণগঞ্জ নয় কেবল, দেশময় প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল সচেতন নাগরিক। দেশের বাইরেও এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হলো। বিচারের দাবি জানালেন সবাই, কিন্তু চার বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। বিচার হয়নি, কবে হবে জানি না। নারায়ণগঞ্জের প্রথম সিটি করপোরেশন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী তাঁর প্রজ্ঞা এবং সৎ রাজনৈতিক উচ্চতায় সহযোদ্ধা বন্ধুদের সঙ্গে ত্বকীর হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। এ জন্য তিনি অনেকের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে শামীম ওসমান আইভীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দ্বিধা করেননি। আবার দুদকে নালিশও করেছেন। তারপরও তো সেলিনা হায়াৎ আইভী দ্বিতীয়বার সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সেই নির্বচনের আগে শামীম ওসমান তিনজনের নাম দিয়েছিলেন মেয়র প্রার্থী হিসেবে কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা আইভীকেই আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী করলেন। এদিকে বিএনপির প্রার্থী হলেন সাত খুন মামলার আলোচিত আইনজীবী সাখাওয়াৎ হোসেন খান। সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে আইভী পুনর্নির্বাচিত মেয়র হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ যে ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে শামীম ওসমানদের কীর্তিকলাপে, তা নিশ্চয়ই গোপন খোঁজখবরে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। এবার শেখ হাসিনা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। সাত খুনের মামলা ত্বকী হত্যার দেড় বছর পর ঘটেছিল। নজরুল ইসলাম, চন্দন সরকারদের হত্যাকারী নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের গডফাদাররাই তৈরি করেছেন। এবার ত্বকী হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনটিকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হলে জানা যাবে এই শুচি-স্নিগ্ধ কিশোর ত্বকীকে কারা কীভাবে হত্যা করেছে।
কামাল লোহানী: ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.