অভিবাসীদের জীবনসংগ্রাম ও রাজনীতি

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ইমেরিটাস প্রফেসর মেঘনাদ জগদীশচন্দ্র দেশাই লেবার পার্টির সদস্য এবং লর্ডসভার সদস্য। কয়েক দশক আগে কোনো এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্ষণিকের আলাপে তিনি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ উদ্যোক্তাকে বলেছিলেন, আপনার কোম্পানির নামে জাতিগত সংখ্যালঘু (ইথনিক) পরিচিতির ছাপ রয়েছে। এটি থাকলে মূলধারার ব্যবসায় সুবিধা হবে না। ইংল্যান্ডে ব্যবসার জন্য ব্র্যান্ডের নাম ইংলিশ কিছু একটা হওয়া উচিত। সত্তর ও আশির দশকের ব্রিটেনে বর্ণবৈষম্যের শিকার হননি এমন বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া কঠিন। সুতরাং লর্ড দেশাইয়ের সেই পরামর্শ ওই বাংলাদেশি উদ্যোক্তার মনে ধরল। তিনি তাঁর কোম্পানির নাম বদলালেন। এখন তাঁর অবস্থান বাংলাদেশি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের তালিকার শীর্ষে। লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকা প্রতিবছর শীর্ষ ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করে থাকে, তাতে কয়েক বছর ধরে তাঁর নামও থাকছে।
গত বুধবার লন্ডনের অভিজাত প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ডিরেক্টরসের ওয়াটারলু মিলনায়তনে তাঁর আত্মজীবনীর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন লর্ড দেশাই। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এই স্মৃতিচারণা শুনে লর্ড দেশাইয়ের মুখে অনেকটা বিস্ময়ের ছাপ। সেটা সামাল দিতে দিতে তিনি বললেন, ‘আগে তো বুঝিনি আমার পরামর্শ এত দামি।’ আত্মজীবনীটি হচ্ছে সিমার্ক গ্রুপের প্রধান ইকবাল আহমেদ ওবিইর (ওবিই হচ্ছে অফিসার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার, ব্রিটিশ রাজপরিবারের দেওয়া খেতাবগুলোর একটি)। একটি প্রতিষ্ঠানের একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ব্রিটেন দুই দেশের শীর্ষ চিংড়ি রপ্তানিকারকের আসনটি দখল করার কাহিনি হচ্ছে এই আত্মজীবনী কিং প্রন। বইটির নামকরণ অনেকটা আক্ষরিক অর্থেই যথার্থ। কেননা, চিংড়ির বাজারে এত বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান খুব বেশি একটা নেই। সিমার্কের কারখানাগুলোতে প্রক্রিয়াজাত হয় প্রতি ঘণ্টায় (বড় ও ছোট মিলিয়ে) ১০ লাখ চিংড়ি। তবে বইটিতে যেমন ইকবাল ব্রাদার্স থেকে সিমার্কে রূপান্তরিত হওয়ার বিবরণ আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আমলাদের কাজের ধারার ভেতরের কথা। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের প্রসারে রাজনীতিকদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্কের রসায়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্রিটেন ও বাংলাদেশে তার কিছু খণ্ডচিত্র এই বইয়ে বেশ ভালোভাবেই উঠে এসেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উৎসাহে কীভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এনআরবি ব্যাংক গড়ে উঠল,
সেই কাহিনিও আছে এই বইয়ে। ইকবাল এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজনীতিকদের মধ্যে লর্ডসভার আরও তিনজন সদস্য এবং হাউস অব কমন্সের একজন সদস্য ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। ঢাকায় দায়িত্ব পালন করে আসা সাবেক দুজন ব্রিটিশ হাইকমিশনার এবং লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনারও এসেছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ব্রেক্সিটে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের মধ্যে তাঁরা, যাঁদের রপ্তানির বাজার হচ্ছে ইউরোপ। স্বভাবতই ওই সব ব্যবসায়ী ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিলেন না। ইকবালও না। কিন্তু এখন নতুন বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ কী? ইকবাল জানালেন, তিনি ফ্রান্সে হিমায়িত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করছেন। যাতে ইউরোপের বাজারে ইউরোপে প্রস্তুত হিসেবে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে পারেন। তাঁর প্রকাশক জন ব্লেক জানালেন, তিনি নাকি রুশদেরও চিংড়ি খাওয়ানোর পরিকল্পনা করছেন। গেল সপ্তাহে লন্ডনে প্রবাসীদের সাফল্য উদ্যাপনের অনুষ্ঠান হয়েছে অন্তত পাঁচটি। এগুলোর মধ্যে আমার দুটিতে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পেশাদারদের সংবর্ধনা জানানোর একটি উদ্যোগ ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার হান্ড্রেড নামে কয়েক বছর ধরেই হয়ে আসছে। এবারও সেটি হয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারি। বিলেতে বাংলা সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে, যার নাম ছিল সত্যবাণী। বিলেতে বাংলা সংবাদপত্রের শত বছর পালনের অনুষ্ঠানটি হয় গত মঙ্গলবার ২১ ফেব্রুয়ারি।
সত্যবাণী এখন নতুন ব্যবস্থাপনায় অনলাইন প্রকাশনা হিসেবে আবার প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ হাইকমিশন সংবর্ধনা দেয় ৮৮ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছাত্রছাত্রীকে। জিসিএসই এবং এ লেভেল পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য এসব ছাত্রছাত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। ওই একই দিন সন্ধ্যায় লন্ডনের স্ট্রান্ড হোটেলে বাংলাদেশি ও ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোর কারিশিল্পের সাফল্য উদ্যাপন করে কারি লাইফ সাময়িকী। কারি লাইফ সাময়িকী মূলত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশি কারির ব্রিটিশ সংস্করণের বৈশ্বিক পরিসরে বাজারজাত করছে। তারা এমনকি এই কারির ব্রিটিশ সংস্করণ ভারতেও নিয়ে গেছে। তাদের এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় শেফ—যাঁরা মিশেলিন স্টার শেফ হিসেবে পরিচিত তাঁদের কয়েকজন। দুজন মিশেলিন স্টার শেফ—ডমিনিক চ্যাপম্যান ও রুপার্ট রাওলি আগামী মাসে আবারও ভারতে কারি উৎসব করতে যাচ্ছেন। মিশেলিন স্টার শেফ, তা-ও আবার দুজনের সঙ্গে একই টেবিলে বসে নৈশাহার করার ভাগ্য খুব বেশি মানুষের হয় না। সেদিক থেকে আমার কপাল নিঃসন্দেহে ভালো। স্ট্রান্ড হোটেলের রেস্তোরাঁর বাংলাদেশি-ব্রিটিশ শেফ আশরাফুল আলমের রন্ধনশৈলীর কথা নাহয় না-ই বললাম। শুধু যেটুকু না বললেই নয় তা হলো, ডমিনিক ও রুপার্ট—দুজনেই রসিয়ে রসিয়ে তাঁদের খাবারের স্বাদ উপভোগ করেছেন। কারি লাইফ সাময়িকীর প্রকাশক ও সম্পাদক দুই সহোদর সৈয়দ বেলাল আহমেদ ও সৈয়দ নাহাস পাশার বিশেষ কৃতিত্ব হচ্ছে, তাঁদের উদ্যোগে ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিকদের সম্পৃক্ত করতে পারা। তাঁদের আয়োজনেও লর্ডসভার অন্তত দুজন সদস্য লর্ড শেখ ও লর্ড বিলমুরিয়া এবং কনজারভেটিভ পার্টির এমপি পল স্কালি হাজির ছিলেন। বাংলাদেশি অভিবাসীদের কারও কারও সাফল্যের এসব কাহিনি অন্যদের জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে; বিশেষ করে নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতায়।
যেখানে বিশ্বায়নের ধারা এখন উল্টোমুখী। আর সে কারণেই অভিবাসীদের পরভূমে ধাতস্থ হওয়াই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে, নতুন দেশের নতুন বাস্তবতায় মূলধারায় যুক্ত হতে পারা। ইউরোপ ও আমেরিকায় অভিবাসীদের জন্য এখন সময়টা ভালো না। ব্রিটেনের ব্রেক্সিট, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের শাসন এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান অভিবাসীদের জন্য দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নব্য জাতীয়তাবাদীদের কাছে এখন সব সমস্যার উৎস অভিবাসীরা। অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, স্কুল কিংবা হাসপাতালের মতো রাষ্ট্রীয় সেবাব্যবস্থায় চাপ, নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ—সবকিছুর জন্যই এখন অভিযোগের আঙুল অভিবাসীদের দিকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অভিবাসন দুটোই এখন বাড়তি কড়াকড়ির মধ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রান্তনীতি অনুসরণের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংঘাত যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপ তৈরি করেছে, তা মোকাবিলার ক্ষমতা ও সামর্থ্য পশ্চিমা দেশগুলোর নেই। ফলে যাঁরা অভিবাসী হতে চান, তাঁদের জন্য বিভিন্ন দেশের সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার ওই সব দেশে ইতিমধ্যে স্থায়ী হওয়া অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্য বাড়ছে এবং তাঁরা নানা ধরনের প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায় অবৈধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়া অভিবাসীদের জন্য আমাদের সরকার সময়ে-সময়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষেত্রে সে রকম কোনো উদ্যোগের কথা আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি; বরং চলতি মাসেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর ইইউ যে সম্মত বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তাতে ইউরোপীয় দেশগুলোতে অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার অঙ্গীকারের কথা রয়েছে।
দেশের বাইরে নানা ধরনের প্রতিকূলতা যখন অভিবাসীদের নিত্যসঙ্গী, তখন তার সঙ্গে আবার বাড়তি উদ্বেগ যুক্ত হয়েছে প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন। জন্মসূত্রের অধিকার ক্ষুণ্ন করার কোনো প্রস্তাবই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নতুন আইনে প্রবাসীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবেন—এমন আশঙ্কা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়, সেটাই প্রত্যাশা। অভিবাসীদের নিয়ে এতসব কথার পাশাপাশি রাজনীতির কথাও কিছুটা বলা দরকার। গেল সপ্তাহেই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সংসদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি দীপু মনি লন্ডনে বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহী ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে এক সান্ধ্য আয়োজনে মিলিত হন। আবার যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগও আগামী মাসে স্বাধীনতার মাস উদ্যাপনের অংশ হিসেবে ওয়েস্টমিনস্টারেই একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। মনে হচ্ছে, বিদেশেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বাড়ানো ক্ষমতাসীন দলের কার্যক্রম জোরদার করাও এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি, সহিংসতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রশ্নে ওয়েস্টমিনস্টারে যতটা বিতর্ক হয়েছে, সে রকমটি আর কোথাও হওয়ার রেকর্ড নেই বলেই হয়তো আওয়ামী লীগের এই উদ্যোগ।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.