সৃষ্টিসুখ আর অনটনের দোলাচলে মৌসুমি-সাদিক

ছোট ছোট পায়ে টুক টুক হাঁটে। এটা ধরে, ওটায় টান মারে। জিনিসপত্র তছনছ। তার সব কাণ্ডই যেন বিস্ময়। এই বিস্ময়ের নাম সামিরা সোহানা সৃষ্টি। ২৬ ফেব্রুয়ারি মেয়েটি দুই বছর পার করেছে। বিকেলে মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে কেনা হয় ছোট একটি কেক আর সামান্য পোলাওয়ের চাল ও মাংস। কিন্তু এসব কিনতে ওর বাবা সাদিকের হিমশিম খেতে হয়েছে। মা মৌসুমি আক্তারও শরীরের যন্ত্রণা সামলে রান্না করেছেন। অভাব আর যন্ত্রণা সাদিক-মৌসুমির প্রতিদিনের সঙ্গী। কারণটা সাভারের রানা প্লাজা। ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ধকল এখনো তাঁরা দুজন সহ্য করছেন। আবার ওই দুর্ঘটনাই সাদিক ও মৌসুমিকে করে দিয়েছে জীবনসঙ্গী। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এই দম্পতির ঘরে আসে সৃষ্টি। সৃষ্টির আগমন সংসারে সুখ এনে দিলেও সাদিক-মৌসুমি স্বাচ্ছন্দ্যে নেই। অভাব ওঁদের নিত্যসঙ্গী। রানা প্লাজায় আটকে পড়ার ঘটনায় এখনো আঁতকে ওঠেন সাদিক-মৌসুমি দুজনই। ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজায় হঠাৎ ধস।
তখন পাশে থাকা মেয়েটির হাত ধরে টেনে পিলারের নিচে আশ্রয় নেন রানা প্লাজার নিউ ওয়েব বটম লিমিটেডের কোয়ালিটি মাস্টার কিউ এম এ সাদিক। চলে বাঁচার বিরামহীন লড়াই। চতুর্থ দিন উদ্ধার হন মৌসুমি। তৃতীয় তলায় আটকা পড়েছিলেন সাদিক। টানা পাঁচ দিন, ঘড়ির কাঁটা হিসাবে ১০০ ঘণ্টা বাঁচার লড়াই করেন তিনি। এরপর ২৮ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। ভবন ধসের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাদিক বলেন, ‘ভবনটি যখন ধসে পড়ে, তখন তৃতীয় তলার এ ও বি ব্লকের পিলারের মাঝখানে আটকা পড়ে যাই। তখন মনে হচ্ছিল, সময় যেন থেমে গেছে। একটু পরেই প্রচণ্ড ধোঁয়ায় সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। টিউব লাইট ভেঙে কাচগুলো আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকে যেতে থাকে। নড়াচড়ার কোনো উপায় ছিল না। হাতে দুটি মোবাইল ফোন সেট, অথচ কোনো নেটওয়ার্ক নেই। এ অবস্থায় দুই দিন কাটাই। প্রচণ্ড পানির পিপাসা লাগে, কিন্তু ওই দুই দিন কোনো পানিও পাইনি। আল্লাহকে শুধু ডাকতাম। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝাড়তাম। এ অবস্থায় দুই দিন থাকার পর তিন বোতল পানি হাতে পাই। পরে দেখি, আমার ঠিক পাশেই আরেকজন মেয়ে আটকা পড়েছে। পানির জন্য কাতরাচ্ছে। পরে তাঁকেও জীবিত উদ্ধার করা হয়।’ আটকা পড়ার প্রথম দিন থেকে গ্রিল কাটার শব্দ পান সাদিক। এতে উদ্ধার হওয়ার খানিকটা আশা জাগে তাঁর। তারপর অনেক চিত্কার চেঁচামেচি করেছেন। কিন্তু উদ্ধারকর্মীদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি সেই শব্দ। দুই দিন পরে উদ্ধারকর্মীরা জানতে পারেন,
ওই স্থানে সাদিকসহ আরও কয়েকজন আটকে পড়ে আছেন। সাদিক বলেন, ‘আমি যে পিলারের মধ্যে আটকা পড়েছিলাম, এর পাশে বেশ কয়েকজন মানুষকে চিত্কার করতে করতে মরে যেতে দেখেছি। একটি মেয়েকে দেখেছি, পানির জন্য সে তার হাত ইট দিয়ে থেঁতলে রক্ত বের করে সেই রক্ত খাচ্ছে। আরেকজনকে দেখেছি, তাঁর পা আটকা পড়েছে। বাধ্য হয়ে লোকটি ইট দিয়ে পায়ে মারতে মারতে দুই দিনে শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। পরে অবশ্য তিনি আর বাঁচতে পারেননি।’ সাদিক বলেন, ঘটনার পর রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে একজন উদ্ধারকর্মী তাঁর খোঁজ পান। তারপর বেশ কয়েকজন উদ্ধারকর্মী এসে তাঁকে বের করার চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হন। সারা শরীর কাচবিদ্ধ। তখন সাদিক বুঝতে পারেন, তাঁর হয়তো আর বাইরের আলো দেখা হবে না। তাই তিনি কাছে থাকা মুঠোফোন, ছবি আর মানিব্যাগটি উদ্ধারকর্মীদের হাতে দিয়ে তাঁর স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ জানান। এরপর একটি সুড়ঙ্গ কেটে ১০০ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার করা হয় সাদিককে। ওই দিনই সাদিককে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সেখানে তিন দিন তাঁর চিকিৎসা চলে। ডান পায়ের ভাঙা পাতায় ব্যান্ডেজ লাগানো হয়। পরে তাঁকে সেখান থেকে চলে আসতে হয়। চার মাস নিজেই নিজের চিকিৎসা চালিয়ে যান। সাভারের ব্যাংক কলোনির ভাড়া বাসা থেকেই হাসপাতালে যেতেন সাদিক। চরম দুর্দিনের সঙ্গী মৌসুমিকে শেষ পর্যন্ত জীবনসঙ্গী করেছেন সাদিক। ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিয়ে করেছেন তাঁরা। তাঁদের সংসারে সুখ এলেও অভাব ঘিরে আছে। অভাব-অনটন কাটাতে চেষ্টার কমতি রাখেননি সাদিক। প্রথমে সাভারের বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় চাকরির চেষ্টা করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না তিনি। তাই বেতনও সাত হাজার টাকার বেশি দেওয়া হতো না। রানা প্লাজার ঘটনার আগে সাদিক আয় করতেন এর দ্বিগুণ। ব্যবসা করতে স্ত্রীকে নিয়ে সাদিক চলে যান দিনাজপুরে শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে মুদি দোকান ব্যবসা করেন। কিন্তু বাকিতে পণ্য নিয়ে মূল্য শোধ করেননি ক্রেতারা। লোকসান গুনে আবারও চলে আসেন সাভারে।
ঠিকানা বাবা কাজী আহসান ফারুকের ভাড়া বাসায়। বাবার পেনশন আর ব্যাংকের কর্মচারী ছোট ভাই জিতুর সাহায্যে মেয়ে সৃষ্টিকে নিয়ে সাদিক-মৌসুমির দিন চলছে। একই অবস্থা স্ত্রী মৌসুমিরও। রানা প্লাজা ধসে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি। মাথায় যন্ত্রণা থাকে এখনো। এ জন্য দুবেলা তাঁর ওষুধ খেতে হয়। সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চার মুখটা দেখার পর সব কষ্ট ভুলে গেছি। সংসারে অশান্তি নাই, কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যা আছে।’ তাঁর ভাষ্য, জীবনটা হতে পারত আরও গোছানো। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে ছিল তাঁর। নিজের টাকায় পড়াশোনা করবেন, তাই গ্র্যান্ড আজাদে ফ্রন্ট অফিস এক্সিকিউটিভের কাজ করতেন তিনি। তখন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। পরে সাভারে পোশাক কারাখানায় চাকরি নেন। চাকরি করেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান পঞ্চম সেমিস্টার পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তখন ঘটে রানা প্লাজার দুর্ঘটনা। সাদিক আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি চাকরি নিলাম আর ছয় মাসের মধ্যেই রানা প্লাজা ধসে গেল। ছয় মাস তো হাঁটতেই পারিনি। পরে আবার পাঁচ মাস শারমিন গ্রুপের শারাফ এপেয়ারেলস নামে পোশাক কারখানায় করেছি।’ রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় সরকারি সাহায্য বলতে ১০ হাজার টাকা বলে জানালেন সাদিক। এরপর আবেদন করেও কিছু মেলেনি। সংসার চালানোর জন্য একটা চাকরি পেলে জীবনের মোড় আবার ঘুরবে—সেই স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা শেষ করতে পারবেন—সেই বিশ্বাস তাঁর আছে।

No comments

Powered by Blogger.