নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে

নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মাঠপর্যায়ে কাজটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর এ কাজে নারীদের ধরে রাখতে হলে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নারীরা মাঠপর্যায়ে এ কাজ করতে পারবেন না—এ ধরনের নেতিবাচক মনোভাবে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। গতকাল রোববার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে প্রথম আলো আয়োজিত ‘নির্মাণশিল্পে নারী প্রকৌশলী ও স্থপতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে সেভেন রিংস সিমেন্টের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আলোচকেরা বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে।
ছাত্রীরা ভালো ফলাফল করে পাস করছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নারী স্থপতি বা প্রকৌশলীর উপস্থিতি সেই তুলনায় কম। ২০৩০ সালের মধ্যে নারী ও পুরুষ প্রকৌশলী ও স্থপতির সংখ্যা যাতে সমান সমান হয়, সে বিষয়টিতেও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান আলোচকেরা। গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, একসময় মানুষ আঙুল তুলে বলত, ‘ওই বাড়িতে মহিলা ইঞ্জিনিয়ার আছে’। কিন্তু এখন বিষয়টা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও অনেক নারী চাকরি করতে পারছেন না। সরকার সরকারি কর্মজীবী নারীদের জন্য ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান করেছে। ৮৪টি শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র তৈরির পাশাপাশি সরকার চাচ্ছে প্রতি জেলায় এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তুলতে। নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন প্রতিমন্ত্রী। সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও বেসরকারি অনেক কারখানা বা কোম্পানিতে তা নিশ্চিত করা যায় না। এটি নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েরা এ কাজ করতে পারবে না—সমাজে প্রচলিত এ ধরনের সামাজিক ‘ট্যাবু’ ভাঙতে হবে। সেভেন রিংস সিমেন্টের পরিচালক তাহমিনা আহমেদ বলেন, নারীদের নিয়োগের সময় অনেক ক্ষেত্রেই চিন্তা করতে হয়, নারীদের নিয়োগ দিলে তাদের জন্য বাড়তি কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ধরনের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেভেন রিংস সিমেন্টের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা আসাদুল হক সুফিয়ানী বলেন, নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের কর্মক্ষেত্রে কোন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, গুণগতমান পরিবর্তনে করণীয় নির্ধারণের জন্যই এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনায় বুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন জেবুন নাসরীন আহমদ বলেন, নারীর কাজের বিচার করছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কর্মক্ষেত্রে সরকার এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। সমাজ ও সমাজের মানুষ এখন পর্যন্ত নারী স্থপতি বা প্রকৌশলীর কাজ মেনে নিতে পারছে না। কর্মক্ষেত্রে একজন পুরুষ যখন ছেলের অসুখের কথা বলে তখন সবাই ওই পুরুষকে দায়িত্বশীলতার জন্য বাহবা দেয়, আর নারীর ক্ষেত্রে বলে ‘অজুহাত’।
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ফরিদা নিলুফার ২৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, এখানে শিক্ষার্থীদের ছেলে ও মেয়ে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয় না। তবে শেখার পরিবেশ ও মাঠের পরিবেশ ভিন্ন। শিক্ষার্থী হিসেবে একজন মেয়ে পরিবার থেকে যে সহযোগিতা পায়, পরে স্ত্রী বা মা হিসেবে পরিবার থেকে ওই নারীর সহযোগিতার ধরনটা পাল্টে যায়। পরিবারের কথা চিন্তা করে নারীরা বিদেশ যাওয়া বা প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। বেসরকারি পর্যায়ে নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করালেও বেতন কম দেওয়া হচ্ছে। পদোন্নতি বা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রেও বৈষম্য করে প্রতিষ্ঠান। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শায়লা জোয়ার্দার নারীদের সুযোগ দিতে হবে কেন বলে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর মতে, নারী নিজের যোগ্যতায় কাজ করবেন। নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে শায়লা বলেন,‘শ্বশুরবাড়ির এলাকায় একবার কাজ করতে গেলাম। নকশা করার সময় এমন মন্তব্যও শুনেছি “ওই বাড়ির বউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে”। কিন্তু কাজ থেকে সরে আসিনি। এ পর্যন্ত মাঠে কেউ আমার কথা শোনেনি, তা হয়নি। নিজের দক্ষতায় জায়গা করে নিয়েছি।’ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব নাইম আহমেদ খান বলেন, পরিবারে একটি ছেলে ও মেয়েশিশুকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বড় করা হয় না। স্থপতি ও নারী প্রকৌশলীদের বেলায়ও ধরেই নেওয়া হয় তাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে পারবেন না। নারীকে বাড়তি নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে কাজ আদায় করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ১৯৯৫ সালে যখন বুয়েট থেকে পাস করেন তখন ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সমান সমান। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখ করে মেরিনা বলেন, কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই পরিমাণ নারীকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিচ্ছেন। স্থপতি হতে হলে মনে রাখতে হবে মাঠে যেতেই হবে,
তাই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব দেন তিনি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী ফাহমিদা হক খান বলেন, ‘শিক্ষকতা করব বলে স্বপ্ন ছিল। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে ঢুকি। কিন্তু স্বামী বুয়েটের অধ্যাপক। সংসারের কথা চিন্তা করে স্বপ্ন পূরণ হলো না। সওজে ঢুকলাম।’ তিনি বলেন, এ পেশায় নারীরা বেশি কাজ করলেও অনেক সময় স্বীকৃতি পায় না। নারীদের নামে অপপ্রচার বেশি হয়। পুলিশে উচ্চপর্যায়ে কর্মরত নারীদের সন্তানদের দেখভালের জন্য যেমন একজন নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়, উচ্চপর্যায়ে কর্মরত অন্য নারীদের জন্যও সে ধরনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে সুপারিশ করেন তিনি। ২০০৩ সালে রাজউকে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রথম নারী হলেন রাহাত মুসলেমীন। তিনি বর্তমানে রাজউকের কেন্দ্রীয় ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। রাহাত বলেন, চাকরিতে ঢোকার পর প্রথম থেকেই ধারণা করা হয়, একজন নারী এ কাজ করতে পারবেন না। তাই অফিশিয়াল কাজ করতে বলে কর্তৃপক্ষ। নারীকে দায়িত্ব দিতে হবে। একইভাবে নারীকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি চাকরিতে স্বামী ও স্ত্রীকে এক জায়গায় পোস্টিং দেওয়ার যে নিয়ম তা বেসরকারি খাতেও চালু করার সুপারিশ করেন তিনি। সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী সালমা আকতার খুকী বলেন, সওজে ২০০ প্রকৌশলীর মধ্যে নারী প্রকৌশলীর সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম। সংখ্যাগত সমতা থাকা জরুরি। ভবিষ্যতে নির্মাণশিল্পে নারীরা যাতে রোল মডেল হতে পারেন, সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.