ওষুধ উদ্ভাবন ও সহজলভ্যতা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ

খ্যাতিমান মানব উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাকিকো ফুকুদা-পার বলেছেন, ওষুধ উদ্ভাবন ও ওষুধের সহজলভ্যতা একুশ শতকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক বাণিজ্য চুক্তি থাকার পরও বিশ্বব্যাপী ওষুধের দাম আকাশচুম্বী হচ্ছে। ওষুধ সহজলভ্য না হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জিত হবে না। গতকাল সোমবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সাকিকো ফুকুদা-পার এ কথা বলেন।
তিনি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির ভাইস-চেয়ার। রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে সিপিডি এ বক্তৃতার আয়োজন করে। দেশের শীর্ষ জনস্বাস্থ্যবিদ, অর্থনীতিবিদ, ওষুধ ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং এনজিও কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য ও বাণিজ্যবিষয়ক বক্তৃতায় সাকিকো ফুকুদা-পার বলেন, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগে ২০১৪ সালে ৮১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এ রোগে সংক্রমণ ও মৃত্যু হারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। এ দেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার (এমডিআর টিবি) প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। যক্ষ্মা চিকিৎসায় গত ৪০ বছর পর দুটি নতুন ওষুধ তৈরি হয়েছে। ওষুধ দুটি এ দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের দ্য নিউ স্কুলের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের এই অধ্যাপক আরও বলেন, উন্নয়নশীল দেশের মতো উচ্চ আয়ের দেশের মানুষও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা এইচআইভি, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক ব্যাধির পাশাপাশি অসংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রেও ঘটছে। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার বিবেচনা করে ওষুধ উদ্ভাবনেও বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত। জন অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় ওষুধের সহজলভ্যতা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সিপিডির চেয়ারপারসন অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, যে ওষুধ (অ্যাসপিরিন) তৈরি করতে পাঁচ সেন্ট খরচ হয় তা নিউইয়র্ক শহরে পাঁচ ডলারে বিক্রি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ১৬-১৭ শতাংশ ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতে।
এটা কাঠামোগত অর্থায়ন সমস্যা। স্বাস্থ্যের ব্যয়নির্বাহের জন্য মহাকাশ গবেষণায় খরচ কমাতে হচ্ছে। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, স্বাস্থ্য অন্য অনেক বিষয়ের চেয়ে আলাদা। আন্তর্জাতিক আলোচনা বা দলিলে স্বাস্থ্যকে ‘বৈশ্বিক গণপণ্য’ (গ্লোবাল পাবলিক গুডস) হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, দুজন বিজ্ঞানী এ দেশে কলেরা চিকিৎসায় স্যালাইন আবিষ্কার করেন। সেই আবিষ্কার ব্র্যাকের সহায়তায় মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। এ দেশের মানুষ খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করতে পারে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এ রকম উদাহরণ আরও আছে। এসব উদাহরণকে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য আলোচনায় সামনে আনতে হবে। বক্তৃতা শুরুর আগে সাকিকো ফুকুদা-পারের পরিচয় তুলে ধরেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, একাধিক ইউএনডিপি মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের প্রধান লেখক অধ্যাপক ফুকুদা-পার। লেখাপড়া করেছেন কেমব্রিজ ও সাসেক্সে। তিনি কলম্বিয়া ও হার্ভার্ডে শিক্ষকতা করেছেন। ফুকুদা-পার, রেহমান সোবহানসহ মুক্ত আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক আলোচক বলেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো যুক্তি দেয় গবেষণা ও পণ্য উন্নয়নের জন্য প্রচুর খরচ হয়। সেই খরচ সে পুষিয়ে নেয় ওষুধের দাম থেকে। ফুকুদা-পার বলেন, গবেষণা ও উন্নয়নে কত খরচ হয় সে ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে ২২ জন অংশগ্রহণকারী প্রশ্ন করেন, মতামত দেন। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের দাপট থাকায় ওষুধের দাম বেশি। ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় মোট রপ্তানি আয়ের ১ শতাংশের কম। এমনকি সেই আয় শাকসবজি রপ্তানি আয়ের চেয়েও কম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

No comments

Powered by Blogger.