নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে কিছু কথা

শুভ সূচনায় মিষ্টিমুখ করানো বাঙালির চিরকালের ঐতিহ্য। পরীক্ষায় কেউ পাস করেছে, তাকে মিষ্টিমুখ করাতে হয়। ঘনিষ্ঠরা মিষ্টির হাঁড়ির গলায় দড়ি বেঁধে ছুটে যায় তার বাড়িতে। তার উপলক্ষে আরও ১০ জনের মিষ্টি খাওয়া হয়ে যায়। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে কিছু খরচাপাতি করে একটা চাকরি পাওয়া গেছে, প্রথম মাসের মাইনে পাওয়ার পর তাঁর বাড়িতে মিষ্টির ছড়াছড়ি। বিয়ের কথা পাকাপাকি হলে বর-কনে দুই পক্ষের বাড়িই মিষ্টিতে সয়লাব হয়ে যায়।
কার ডায়াবেটিস আছে আর কার নেই, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। প্রমোশন পাওয়ার পরে পদোন্নতির চিঠি এবং কয়েক পাত্র মিষ্টি নিয়ে বাড়ি আসেনি এমন কৃপণ ও বেরসিক মানুষ বাঙালি সমাজে দুর্লভ। সেই সমাজে যদি কেউ কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান, তাঁকে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য তাঁর শপথ গ্রহণের দিনটি পর্যন্ত অপেক্ষা করবে—এমন ধৈর্যশীল মানুষকে কল্পনা করাও বোকামি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় কে এম নুরুল হুদাকে তাঁর পটুয়াখালীর বাউফলের বাসায় গিয়ে স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতা মিষ্টি খাইয়ে দেন। অবশ্য নবনিযুক্ত সিইসি প্রথম আলোর সংবাদদাতাকে বলেছেন, ‘তাঁদের কেউই দলগতভাবে ফুল দিতে [বা মিষ্টান্ন খাওয়াতে] আসেননি। তাঁরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। কেউবা আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, কেউবা একই গ্রাম বা ইউনিয়নের। এখানে রাজনৈতিক কোনো ব্যাপার ছিল না।’ রাজনীতির সঙ্গে মিষ্টির সম্পর্ক প্রত্যক্ষ নয়, সম্পর্কটা পরোক্ষ। বস্তুত, রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সম্পর্ক কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, খাসির রেজালা, ভুনা খিচুড়ি—অনেক কিছুরই। নির্বাচনের আগের দিন ওসব খাদ্যবস্তু রাজনীতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।
কোনো শুভ মুহূর্তে কাউকে মিষ্টিমুখ করানো দোষের কিছু নয়। নবনিযুক্ত সিইসির মিষ্টান্ন-পর্ব থেকে একটি অতীব জরুরি জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। মিষ্টিমুখ করানোতে যেমন ‘রাজনৈতিক কোনো ব্যাপার’ ছিল না, তেমনি সিইসির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বিএনপিপন্থী কেউ নেই। সেই না-থাকাটা বিশেষ ‘রাজনৈতিক ব্যাপার’। এবং তার তাৎপর্য বঙ্গীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরাট। লজিকের ভাষায় হাইপোথেটিক্যালি যদি ধরে নিই যে মিষ্টির পাত্র নিয়ে তাঁর বাড়িতে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল বা জাসাসের কয়েকজন নেতা যেতেন, তাঁরা নিজের হাতে দুটো রসগোল্লা বা কালোজাম খাইয়ে দিতেন, তাহলে তিনি সে মিষ্টির স্বাদ যা-ই হোক, সানন্দে খেতেন কি না? এখন অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন যে পঞ্চাশের কম বয়সী বহু মানুষ নিজের বিএনপিপন্থী বাবাকে বাপ বলে পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করেন। অন্যদিকে ঘোরতর রাজাকার জন্মদাতাকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দিতে অনেকেই লেশমাত্র দ্বিধা করে না। এর অর্থ হলো এই, আমাদের সমাজ থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক—মানবিক সম্পর্ক—চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে রাজনীতির দূষিত বাতাসে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে গত দুই-আড়াই মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব।
১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের রাজার ম্যাগনা কার্টা স্বাক্ষরের পরবর্তী ৮০০ বছরে গণতান্ত্রিক বিশ্বে যা ঘটেনি, তা-ই ঘটেছে বাংলাদেশে ২০১৭ সালে। যে কৃষক শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে রাতের বেলা তাঁর খেতে পানি দেন ও ট্রানজিস্টার শোনেন, অথবা যে কিশোর পিঠে ব্যাগ নিয়ে কলেজে যায়, তার ধারণা হতে পারে, নির্বাচন কমিশন এক বিরাট ব্যাপার। পৃথিবীর খুব মানুষেরই সে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা রয়েছে। এবং সে দায়িত্ব যিনি বা যাঁরা পালন করবেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বা কোনো দলের নেতার সঙ্গে তাঁর বা তাঁদের চৌদ্দ পুরুষের তিলমাত্র সম্পর্ক থাকলে তিনি অযোগ্য বা ডিসকোয়ালিফাইড। অনুসন্ধান কমিটি যখন নির্বাচন কমিশনারদের খোঁজে সন্ধানী-আলো নিয়ে ছোটাছুটি করে গলদঘর্ম হচ্ছিল, তখন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শয্যাগত ছিলাম। ২০-২৫ বছর যাবৎ সুষ্ঠু নির্বাচন-নির্বাচন করে কথা বলে, গলা শুকিয়ে ফেলেছি বলে মিডিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়েছে। তাঁদের আমি বলেছি, দেশে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞজনের অভাব নেই। অসুখ-বিসুখের মধ্যে মাথার ঠিক নেই, কিসের মধ্যে কী বলি, আমাকে মাফ করেন। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে আমার নিজের গতরতন্ত্র ঠিক রাখা বা সুস্থ থাকা অনেক বেশি জরুরি।
প্রচারের জন্য নয়, ব্যক্তিগতভাবে জানার জন্য এক সাংবাদিক আমাকে জানতে চেয়েছিলেন, বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন কমিশনারদের অনুসন্ধানে আপনাকে যদি ছুটতে বলা হতো, তাহলে আপনি কী করতেন? আমি বলেছিলাম, ঘরের খেয়ে কেউ আমাকে মোষ তাড়াতে বললে, আমি সম্মত হতাম না। কারণ, একজন নাগরিক হিসেবে ওটা আমার দায়িত্ব নয়। সরকারের কাজ সরকার করবে, তারা কোনো অন্যায় বা ভুল করলে সচেতন নাগরিক হিসেবে কেউ তার সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু সরকারের কাজ সরকারকেই করতে দেওয়া উচিত। তারপরও সরকার যদি স্বচ্ছতার স্বার্থে কোনো নাগরিকের সহায়তা বা পরামর্শ চায়, তাহলে সে পরামর্শ দেওয়া নাগরিকের দায়িত্ব। তবে প্রার্থী নির্বাচন করতে গিয়ে গোপনীয়তার লেশমাত্র থাকা উচিত নয়। অনুসন্ধানের দায়িত্ব আমি পেলে অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকরিতে রয়েছেন এমন বেসামরিক, সামরিক, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের দুই-আড়াই শ কর্মকর্তার জীবনবৃত্তান্ত নিতাম। তাঁদের অতীত পর্যালোচনা করে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম এবং তা থেকে সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করতাম। আমাদের তালিকা নিয়ে সরকারি দল বা সংসদের বাইরের বিরোধী দল কী বলল, তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
নির্বাচনে কমিশনের কাজটা কোনো বাঘ-ভালুক ব্যাপার নয়, সততা, নৈতিক বল ও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকলে যে কেউই নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মানুষ হিসেবে যদি কেউ সৎ হন এবং থাকে তাঁর নৈতিক বল ও প্রশাসনিক দক্ষতা, তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেন অথবা খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের রক্তসম্পর্কের আত্মীয়ের পক্ষেও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। কথাটি অতিরঞ্জন মনে হবে, কিন্তু আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, বাংলাদেশে দক্ষ কর্মকর্তার আকালের মধ্যেও অন্তত ৬০টি নির্বাচন কমিশন গঠনের মতো শ তিনেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁদের দ্বারা সরকার চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। যেকোনো দেশের সাধারণ নির্বাচন একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। জনবহুল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রযোজ্য। সেদিন আমি কথাচ্ছলে একজন সাংবাদিককে বলেছিলাম, আমার ছেলেমেয়েদের সহপাঠী উপসচিব বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার পর্যায়ের অনেক দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা আছেন, যাঁদের দায়িত্ব দিলেও ভালো নির্বাচন করতে পারবেন। অনেক উপনির্বাচন করে তা দেখিয়েছেন তাঁরা। উপনির্বাচন সুষ্ঠু হলে অথবা কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভালো হলে সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠু হতে বাধা কোথায়? তবে হ্যাঁ, বাধা আছে। সে বাধা দূর করাই একটি ভালো নির্বাচন কমিশনের কাজ। ভোটের আগের রাতে অথবা ভোটের দিন ‘সিল মারো ভাই সিল মারো’ মার্কা মোটরসাইকেলঅলা ব্রিগেডের সদস্যদের ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা তাদের দায়িত্ব। পাঁচজন কমিশনার নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারেন না। তাঁরা তদারকি করেন। নির্বাচনের সঙ্গে যে ছয় লাখ কর্মচারী-কর্মকর্তা জড়িত, তাঁদের ওপর নজরদারি করাই নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব। নির্বাচনকালীন সরকারকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারেন, তাহলে সেই নির্বাচন কমিশন অর্থহীন। কোন দল নির্বাচনের পর সরকার গঠন করবে,
সেদিকে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দৃষ্টি থাকে। সেখান থেকেই নির্বাচন প্রভাবিত হয়। অতীতে সে রকম ঘটনা আমরা দেখেছি। কথায় কথায় আমরা ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার  টি এন সেশনের উদাহরণ দিই। সেশন ব্যক্তি নন, তিনি ভারতীয় উচ্চতর ব্যুরোক্রেসির একজন সেরা প্রতিনিধি মাত্র। তিনি না হলে তাঁর ক্যাডারের অন্য যে কেউই তাঁর মতোই দায়িত্ব পালন করতেন। কারণ তাঁরা জানেন, কী তাঁদের কর্তব্য। বহু বছর আমি ভারতের গান্ধীবাদীদের সঙ্গে চলাফেরা করেছি। অশোকা গুপ্ত ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী নারকীয়তার পরে গান্ধীজির কর্মী বাহিনীর সঙ্গে এসেছিলেন ত্রাণকাজে। কলকাতায় আমি তাঁর বাড়িতে অনেকবার অতিথি হয়েছি। তাঁর স্বামী শৈবাল গুপ্ত ছিলেন গান্ধীজির স্নেহভাজন। সেই সূত্রে বিধানচন্দ্র রায়ের এবং জওহরলাল নেহরুরও। শৈবাল গুপ্তের অগ্রজ বন্ধু সহকর্মী ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। সুকুমার সেনের বহু গল্প আমি অশোকা গুপ্তের কাছে শুনেছি। তিনি আইসিএস কর্মকর্তা হিসেবে গান্ধী-নেহরু উভয়েরই প্রীতিভাজন ছিলেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি হবু শাসক দল কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আরও অনেক কর্মকর্তার মতো। ১৯৪৭-এর পরে সুকুমার সেন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম চিফ সেক্রেটারি হন। ১৯৫০-এ পণ্ডিত নেহরু যখন তাঁকে দিল্লি ডেকে নিয়ে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাব দেন, তিনি বলেছিলেন, সে দায়িত্ব তিনি নিতে পারেন; যদি তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার দায়িত্ব দেন। কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের কোনো রকম হস্তক্ষেপ তিনি সহ্য করবেন না। নেহরু নাকি বলেছিলেন, আমিও সেটাই চাই বলে আপনাকে নিয়োগ দিচ্ছি। তাঁর অধীনে নির্বাচন করে বড় বড় কংগ্রেস নেতা হেরে গেছেন। কিন্তু ভারতে তিনিই প্রথম ‘পদ্মবিভূষণ’।
আমরা শুধু সেশনের নামটা শুনেছি। বাঙালি সুকুমার সেন শুধু ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীতে একজন নিরপেক্ষ ও যোগ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৫৩-তে তিনি আন্তর্জাতিক নির্বাচন কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা লাভের আগে সুদানে ১৯৫৩-তে যে গণভোট হয়, তা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতের সুকুমার সেনকে। তিনি ছিলেন একজন কংগ্রেস-সমর্থক কর্মকর্তা। কিন্তু সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার কাছে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস পরাভূত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কি আমাদের অন্য কোনো গ্রহ থেকে আনতে হবে সুকুমার বাবুর মতো একজন নির্বাচন কমিশনার? পরিশেষে প্রসঙ্গত একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। যেকোনো সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মতোই নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন কখনো শূন্য থাকার কথা নয়। একটির মেয়াদ শেষ হতেই আরেকটি দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশন শপথ নেওয়ার আগে কে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার? এ রকম একটা অবস্থা ভারতে হয়েছিল সেশনের দায়িত্ব গ্রহণের আগে। পেরি শাস্ত্রীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দুই সপ্তাহ শ্রীমতী ভি এস রমা দেবী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। খেয়ালখুশি নয়, রাষ্ট্র সাংবিধানিক বিধিমতো চালাতে চাইলে তেমনটিই হয়ে থাকে। তবে পৃথিবীর বহু দেশের সরকারই সংবিধানের বিধিবিধানের পরোয়া করে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.