জাদুঘরে নান্দনিক মৃৎশিল্পের সমারোহ

প্রথমেই স্বাগত জানাবে মৃৎশিল্পীদের দেবতা বিশ্বকর্মা। তারপরই আছে দুটি ধাপে কিছু পাটের ব্যাগ। এরপর মাটি পোড়ানোর চুল্লি। এর চারপাশ ঘিরে নানান তৈজসপত্র। চারদিকে চোখ বোলালেই দেখা যাবে মাটির তৈরি হরেক রকম জিনিস। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে চলছে মৃৎশিল্পীদের শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার-সংলগ্ন গ্রাম মিঠাপুর ও জামালপুরের মৃৎশিল্পীদের নিয়ে সপ্তাহব্যাপী এই পোড়ামাটির প্রদর্শনী ও মেলা শুরু হয়েছে গত শুক্রবার থেকে। চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত।
এক টেপা পুতুলেরই কত বর্ণ আর আকার-আকৃতি। কোনোটার নাচের ভঙ্গি, কোনোটা সন্তান কোলে, আবার কোনোটা ঘোড়ায় চড়েছে। মাছ, ময়ূর, পাখি, হাতি, ঘোড়া, বিভিন্ন রকম টেরাকোটা ও ফুলের টবে এই প্রদর্শনকক্ষটিতে যেন এক টুকরা গ্রামীণ পরিবেশের ছোঁয়া। গতকাল সোমবার দেখা যায়, কমল চন্দ্র পাল নিজের স্টলে বসেই ময়ূরের পাখার কারুকাজ করছিলেন। পাশেই একটি মাছ ও রাজহাঁস বানানো। এখনো কাঁচা। পোড়ানোর ব্যবস্থা নেই বলে বাতাসে শুকানোর জন্য রেখে দিয়েছেন। ঘর সাজানোর মৃৎসামগ্রীর পাশাপাশি হাঁড়ি, পিঠা তৈরির পাত্র, কলস, সরা, ঢাকনাসহ অনেক ব্যবহারিক সামগ্রীও রয়েছে। লুবানা হক খুব আগ্রহের সঙ্গে কয়েকটি টেপা পুতুল হাতে নিয়ে দেখছিলেন। তিনি বলেন, ‘ছোট সময়ে বড়দের হাত ধরে মেলায় যেতাম। সেখানে পাওয়া যেত এই জিনিসগুলো। কত পুতুল যে পথেই ভেঙেছি। ঢাকায় এসে এগুলো আর দেখিনি। আজকে দেখে ওই সময়ের কথা মনে হলো।’ ইউনেসকোর রকফান্ড অ্যান্ড ট্রাস্টের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ এর আয়োজক। মিঠাপুর ও জামালপুর গ্রামের ২৬ জন মৃৎশিল্পীকে টেরাকোটার ওপর এক বছর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে সেরা ২০ জন শিল্পী এবারের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন নারী শিল্পী। প্রত্যেকেই বংশপরম্পরায় এই মৃৎশিল্পী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, ‘আমরা তাঁদের বলিনি এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে।
শুধু ধারণা দিয়েছি। এই শিল্পীরা নিজেরাই প্রতিটি জিনিস বানিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ঢাকার যাঁরা কারুশিল্পের বিপণন করেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় এবং বড় পরিসরে তাঁদের জন্য বাজার তৈরি করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। এই শিল্পীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ও শিল্পটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি চেষ্টা এই প্রদর্শনী। গুরুদাশির বয়স ৫২। বাপ-দাদার পেশা তিনি ধরে রেখেছেন। সংসারের কাজে লাগে এমন জিনিসই বানাতেন। কিন্তু এখন তাঁর স্টলে শোভা পাচ্ছে নান্দনিক নানান জিনিস। তিনি বলেন, ‘আমাগের ওখান টেরাকোটা শিখায়। ওখন অনেক কিছুই বানাত পারি।’ দুই মেয়েকেও তিনি শিখিয়েছেন। মমতা রাণীর (৩০) স্বামী গ্রামে একটি দোকান চালান। সংসারের প্রয়োজনে নিজের শিল্পী সত্তা দিয়ে মাটির টব, হাঁড়ি তৈরি করতেন। গ্রামের মানুষের কাছে এসবের চাহিদাই বেশি। প্রশিক্ষণের পর নানান রং-ঢঙের টব বানিয়েছেন তিনি। প্রদর্শনীতে এসে শিল্পীরাও খুশি, নিজেদের কাজগুলো ঢাকার মানুষকে দেখাতে পেরে।

No comments

Powered by Blogger.