নিক্বণ সচকিত শিল্পকলায়

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে গতকাল জাতীয় নাট্যশালায় শুরু
হওয়া নৃত্যাঞ্চল উৎ​সবের উদ্বোধনী​​ দিনের একটি পরিবেশনা
আজ দিনটি পার হলেই কাল আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। এরই মধ্যে উৎসবের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে। ‘নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া, বিশ্ব তনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।’ দিবসটি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ পঙ্ক্তি দুটো পোস্টারের স্লোগান করা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির দেয়ালে স্থান পেয়েছে পোস্টারটি। গতকাল বুধবার শিল্পকলা একাডেমি ঘুরে বুঝতে বাকি রইল না দিনটি চলে এসেছে কাছে। বিকেল থেকে নূপুরের নিক্বণে সচকিত হয়েছিল জাতীয় চিত্রশালা প্লাজা এবং জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনের চারপাশ। সারাক্ষণ এ আওয়াজ কানে আসছিল। এ দেশে ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ মোটেও নতুন কিছু নয়। আধুনিক ব্যালের জনক জঁ-জর্জেস নোভেরের জন্মদিন স্মরণে ১৯৮২ সালে দিনটির সূচনা করে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট। দিবসটি পালনের মূল উদ্যোক্তা নাচের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ড্যান্স অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের নৃত্যবিষয়ক কমিটি। তাদের এই উদ্যোগকে পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের শিক্ষা-সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো গ্রহণ করে। ফলে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নৃত্য দিবসটি উদ্যাপনের জন্য আহ্বান জানানো হয় ইউনেসকোর সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে। কোন দিনটিকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস হিসেবে পালন করা হবে, তা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও পরবর্তী সময়ে ঠিক করা হয়, ফ্রান্সের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী জঁ-জর্জেস নোভেরের জন্মদিনে পালন করা হবে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। বিশ্ব নৃত্যের দূত জঁ-জর্জেস নোভেরের জন্ম ১৭২৭ সালের ২৯ এপ্রিল প্যারিসে। তিনি ১৭৫৪ সালে ব্যালে নৃত্য আবিষ্কার করেন। নৃত্যসংস্কারক হিসেবেও ছিল তাঁর খ্যাতি। ২৬ বছর ধরে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা এই দিবসটি পালন করে আসছে। এ বছরও বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি উদ্যাপন করছে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা। ‘চিত্ত মম বিকশিত হোক নৃত্যের তালে তালে’ শিরোনামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার যৌথ আয়োজনে উদ্যাপন করেছে সপ্তাহব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে শুরু হওয়া এ উৎসবটি চলছে চিত্রশালা প্লাজায়। প্রতিদিন নৃত্য পরিবেশনার পাশাপাশি মেলার আয়োজনও রয়েছে এখানে। আগামীকাল ২৯ এপ্রিল সকাল ৯টায় আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানমালা। থাকছে সকাল ৭টায় একাডেমি প্রাঙ্গণ কফি হাউসে মঙ্গলনৃত্য, সকাল ১১টায় সেমিনার। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে এটি উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা লায়লা হাসান। ‘বাংলার শেকড়ের সংস্কৃতি ও বাংলাদেশে নৃত্যচর্চা’ শীর্ষক শেখ মেহেদী হাসানের প্রবন্ধের ওপর উন্মুক্ত আলোচনা, সন্ধ্যা ছয়টায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস ২০১৬ উপলক্ষে আজীবন সম্মাননা প্রদান, দেশের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনায় নৃত্যানুষ্ঠান ও আলোচনা। গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে নৃত্যাঞ্চল আয়োজিত তিন দিনব্যাপী নৃত্য উৎসবের উদ্বোধন হয়। জাতীয় নাট্যশালার ভিআইপি গ্রিনরুমে গতকাল সন্ধ্যায় কথা হলো জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের সঙ্গে। নৃত্যাঞ্চলের উৎসব শুরু হবে একটু পরে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, নৃত্যে দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে পার্থিব ও অপার্থিব সব ভাব প্রকাশের সুযোগ পায় মানুষ। এই প্রকাশভঙ্গিতে থাকে গতি ও ছন্দ। সেই গতি ও ছন্দের তালে তালে ফুটে ওঠে প্রেম, ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ, প্রতিবাদ। সমাজ কিংবা গল্প-ইতিহাসের কথাও নাচের মাধ্যমে উঠে আসে। নাচ শুধু বিনোদন নয়, নাচ জীবনের প্রতিবিম্ব। মঞ্চে নৃত্যরত ভঙ্গিমায় থাকা একটি ভাস্কর্যের দুই পায়ে দুটি ঘুঙুর পরিয়ে যৌথভাবে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যগুরু লীলা স্যামসন ও বিশেষ অতিথি চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। এর আগে নৃত্যগুরু পণ্ডিত বিরজু মহারাজ স্মরণে গুরুবন্দনা পরিবেশন করেন শিল্পীরা। গতকাল উদ্বোধনী সন্ধ্যা সাজানো হয় কত্থক নাচ দিয়ে। এতে নৃত্যাঞ্চলের দুই শতাধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। উৎসবের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে লীলা স্যামসন উৎসবের উদ্বোধনী চমকের প্রশংসা করে বলেন, অসাধারণ একটি নৃত্যসন্ধ্যা হচ্ছে আজ। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মুস্তাফা মনোয়ার রবি ঠাকুরের একটি মন্তব্য (পৃথিবীর ৩ ভাগ নৃত্যলোক আর ১ ভাগ শব্দালোক) উল্লেখ করে বলেন, প্রতিটি মানুষ জীবনের পাঁচ-ছয় বছর নৃত্য করে। মানুষের চলার গতি, সুন্দরের গতি সবই তো নৃত্যলোক। নৃত্যকলা হচ্ছে ভারি সুন্দর একটা বিষয়। উদ্বোধনী আয়োজনে দেশের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী রাহিজা খানম ঝুনুকে দেওয়া হয় নৃত্যাঞ্চল সম্মাননা। আজ এ উৎসবের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার ‘নৃত্যাঞ্চল’ ও ‘সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার’ যৌথভাবে মঞ্চস্থ করবে ইতিহাসখ্যাত কাহিনি আলী বাবা ও চল্লিশ চোর অবলম্বনে নৃত্যনাট্য বাঁদী-বান্দার রূপকথা। কাল তৃতীয় ও শেষ দিন ‘বিশ্ব নৃত্য দিবস’ উপলক্ষে সুবিধাবঞ্চিত ও বিশেষ শিশুদের (প্রতিবন্ধী) নৃত্যানুষ্ঠান। নৃত্যাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও উন্মুক্ত মঞ্চে তাদের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করবে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন স্কুল সংগঠনের প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থী নৃত্যে অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন শিবলী মহম্মদ।

No comments

Powered by Blogger.