নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ সক্ষমতা by বদিউল আলম মজুমদার

সম্প্রতি প্রথম আলোতে আমি একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। আমার লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম আসাদুজ্জামান একটি প্রতিবাদ পাঠিয়েছেন, যা গত ১০ ডিসেম্বরের প্রথম আলোর চিঠিপত্র কলামে ‘হালনাগাদ ভোটার তালিকা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। চিঠিতে জনাব আসাদুজ্জামানের উত্থাপিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা নিয়ে আমার এই লেখা।
উপরিউক্ত চিঠিতে জনাব আসাদুজ্জামান দাবি করেছেন যে ‘প্রথম আলোর ৬ ডিসেম্বর সংখ্যায় “নির্বাচন নিয়ে কিছু সংশয়” শিরোনামে লেখায় বদিউল আলম মজুমদার ভোটার তালিকা ও পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন।’ আমি জনাব আসাদুজ্জামানের বক্তব্যে হতাশ হয়েছি। কারণ, ওই লেখায় আমি কোনো অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করিনি। বরং ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ ও ব্যর্থতার দায় স্বীকার না করে এবং নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে কমিশন মিথ্যা ও বিভ্রান্তির আশ্রয় নিয়েছে।
আমি লিখেছিলাম, ‘নতুন ভোটারদের (১ জানুয়ারি ২০১৫ যাঁদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে) পৌর নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি উঠেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আইন লঙ্ঘন করে ২০১৫ সালের জানুয়ারির পরিবর্তে জুলাই-আগস্ট মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করায় এসব ভোটার আসন্ন নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।’ এ বক্তব্য অসত্য তো নয়ই, বিভ্রান্তিকরও নয়।
ভোটার তালিকা আইন ২০০৯-এর ১১ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কম্পিউটার ডেটাবেজে সংরক্ষিত বিদ্যমান সকল ভোটার তালিকা, প্রতি বৎসর ২ জানুয়ারি হইতে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নিম্নোক্তভাবে হালনাগাদ করা হইবে যথা: (ক) পূর্বের বৎসরের ২ জানুয়ারি হইতে যিনি ১৮ বৎসর বয়স পূর্ণ হইবার কারণে ভোটার হইবার যোগ্য হইয়াছেন অথবা যোগ্য ছিলেন, কিন্তু ধারা ১০ এর অধীনে তালিকাভুক্ত হন নাই, তাঁহাকে ভোটার তালিকাভুক্ত করা হইবে।’ অর্থাৎ ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে যাঁদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাঁরা আইনানুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালিত হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন।
কিন্তু জনাব আসাদুজ্জামানের চিঠিতে দাবি করা হয়, ‘২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি যাঁদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, এরূপ ৯৩ হাজার ২০০ জন ২০১৪ সালের হালনাগাদ ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এই নতুন ভোটারদের অনেকেই তাঁদের এলাকায় ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন এবং আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনেও অংশগ্রহণ ও ভোট দিতে পারবেন।’ লক্ষ করুন, জনাব আসাদুজ্জামানের দাবি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি যাঁদের ১৮ পূর্ণ হয়েছে, তাঁরা ২০১৪ সালের হালনাগাদ করা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটও দিয়েছেন। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের সৌজন্যে ৯৩ হাজার ২০০ ভোটার ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছেন!
কারও বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হলে তাকে আইনের ১১ (১) (ক) ধারা অনুযায়ী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। তাই নির্বাচন কমিশন যদি ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি যাঁদের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, সে রকম ৯৩ হাজার ২০০ জনকে ২০১৪ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় ভোটার করে থাকে, তাহলে কমিশন সুস্পষ্টভাবে আইন ভঙ্গ করেছে। আর কমিশনের আইনভঙ্গের কারণে অযাচিতভাবে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়ে যদি এসব ব্যক্তি, জনাব আসাদুজ্জামানের দাবি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন, কমিশনকে সেই অন্যায়ের দায়ও নিতে হবে।
লক্ষণীয়, আইনের ১১ (১) (ক) ধারায় সুস্পষ্ট করা আছে যে ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে যাঁদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাঁরা ২০১৫ সালের হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর ২০১৫ সালের হালনাগাদ কার্যক্রম কমিশন ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের পরিবর্তে—তাও আইনের ১১ (১) ধারা লঙ্ঘন করে—জুলাই মাসে শুরু করেছে, যা চূড়ান্ত হবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি যাঁদের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাঁদের চলমান হালনাগাদকৃত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই ভোটার হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন দু-দুবার ভোটার তালিকা আইন লঙ্ঘন করেছেন—একবার আইনানুযায়ী জানুয়ারির পরিবর্তে জুলাই মাসে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করে; আরেকবার ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হয়নি, এমন ব্যক্তিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রসঙ্গত, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম নিয়ে কমিশন অন্যভাবেও আইন ভঙ্গ করেছে। আইনের ৭ (৭) ধারা অনুযায়ী, ‘ভোটার তালিকা নির্ধারিত পদ্ধতিতে তথ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে এবং হালনাগাদকৃত তালিকা দ্বারা উহা প্রতিস্থাপিত হইবে।’ কিন্তু কমিশনের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ ২০১৪ সালের হালনাগাদের এক পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ ছাড়া ভোটার তালিকার আর কেনো তথ্য নেই। এ কারণে নাগরিক হিসেবে আমাদের কোনোভাবেই হালনাগাদের সঠিকতা যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমরা অনুসন্ধান করে দেখতে পারি না কীভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ভোটার হওয়ার অযোগ্য ব্যক্তিরা ভোটার তালিকায় যুক্ত হলো। নাকি এতে অন্য ধরনের কোনো কারসাজি আছে!
প্রসঙ্গত, কমিশন দাবি করছে যে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ামাত্র ৯৩ হাজার ২০০ জন ভোটার ২০১৪ সালের হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ২০১৫ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় আরও বেশি নতুন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় ৪৬ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫০ ভোটার যুক্ত হয়েছিলেন। জানা গেছে, এবার জুলাই-আগস্ট মাসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য নেওয়ার পর প্রায় ৪৩ লাখ সম্ভাব্য নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন (১ অক্টোবর পর্যন্ত)। অবশ্য ২০১৫ সালের তালিকা চূড়ান্ত হবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে। তর্কের খাতিরে
যদি ধরে নেওয়াও হয় যে নতুন ভোটারদের মধ্যে মাত্র ৯৩ হাজার ২০০ জন ২০১৪ সালের তালিকায়—যদিও অযাচিতভাবে—যুক্ত হওয়ার কারণে পৌর নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন, তাহলে বাকি প্রায় ৪২ লাখ নতুন ভোটােরর কী হবে? তাঁরা তো আইন ভঙ্গ করে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা দেরিতে হালনাগাদ শুরু করার কারণে আসন্ন নির্বাচনে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, এটাই ছিল আমার আগের উপসম্পাদকীয়র বক্তব্য। জনাব আসাদুজ্জামান এ ব্যাপারে কমিশনের আইন লঙ্ঘন ও ব্যর্থতার কথা স্বীকার না করে জনমনে মিছেমিছি বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করেছেন।
জনাব আসাদুজ্জামান তাঁর চিঠিতে আরও দাবি করেছেন, ‘বদিউল আলম মজুমদার ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাও বস্তুনিষ্ঠ নয়। ২০১৪ সালের হালনাগাদে নারীর চেয়ে পুরুষ ভোটার কোনো কোনো এলাকায় কিছু বেশি হয়েছে, তবে তা জাতীয়ভাবে খুব বেশি নয়।’ আর আমি লিখেছিলাম, ২০১৫ সালের ২ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত খসড়া সাপ্লিমেন্টারি তালিকা অনুযায়ী, ২০১৪ সালের হালনাগাদ কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া প্রায় ৪৭ লাখ নতুন ভোটারের মধ্যে ‘জেন্ডার গ্যাপ’ ছিল ১২ শতাংশ, অর্থাৎ ৫৬ জন পুরুষের বিপরীতে ৪৪ জন নারী, যা অবাস্তব। ফলে যে ভোটার তালিকা নিয়ে আসন্ন পৌর নির্বাচন হবে, তা ত্রুটিযুক্ত।
জনাব আসাদুজ্জামান এ বিষয় সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। বরং তিনি দাবি করেছেন, ‘১৫ জুন ২০১৫ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেইস অনুযায়ী পুরুষ ও নারী মোট ভোটারের শতকরা হার যথাক্রমে ৫০ দশমিক ৩৯ এবং ৪৯ দশমিক ৬১...’। কিন্তু ২০০৮ সালের সেনাবাহিনীর সহায়তায় তৈরি ভোটার তালিকা, যা ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সবচেয়ে নিখুঁত, তাতে নারী ভোটার ছিল পুরুষ ভোটার থেকে ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ বেশি এবং ভোটার তালিকায় নারী-পুরুষের বিভাজন বা ‘জেন্ডার গ্যাপ’ ছিল +১.৭৪ %।
ভোটার তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ, আমাদের প্রায় এক কোটি নাগরিক বিদেশে কর্মরত, যাঁদের প্রায় সবাই পুরুষ এবং তাঁদের অধিকাংশই, আবারও কমিশনের ব্যর্থতার কারণে, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নন। তাই জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান হলেও বাস্তবতার কারণে ভোটার তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যাই বেশি হওয়ার কথা।
পরিশেষে, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এ ব্যাপারে কমিশন আইনকানুন ও বিধিবিধানের কোনো রকম তোয়াক্কাই যেন করছে না! বরং কমিশন
যেন একধরনের তুঘলকি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, যা কমিশনের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে পারে না।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক (৬ জানুয়ারি ২০১৬)।

No comments

Powered by Blogger.