৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে নানা প্রশ্ন by মোশতাক আহমেদ

সরকার আরও ছয়টি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিয়েছে। যদিও দেশের বিদ্যমান ৮৫টি (একটি মামলায় চলছে) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০-১২টি ছাড়া অন্যদের বিরুদ্ধে শর্ত না মানাসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিন দফায় সময় বাড়ানোর পরও মাত্র ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আরও ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় দুটি এবং চট্টগ্রাম, খুলনা, কুষ্টিয়া ও মানিকগঞ্জে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে মন্ত্রী, ছাত্রলীগের সাবেক নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা আছেন।
সরকারের নীতি ছিল, যেসব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া। কিন্তু এবার অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কেবল একটি হবে মানিকগঞ্জে, যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অন্য জেলায় সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় প্রায় ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এখন আরও অনুমোদন দিয়ে সমস্যা বাড়ানো হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদেরা।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় এমনিতেই অতিরিক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। ঢাকায় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। বরং যেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে কিছু সরানো উচিত। একেবারে বিশেষায়িত হলে এবং যদি এমন হয় যে ঢাকায় ছাড়া সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে এক একর নিজস্ব জমিতে ক্যাম্পাস থাকলেই কেবল বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলা হচ্ছে সেগুলো সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় বলে মনে হচ্ছে।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শর্তানুযায়ী নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি তাদের চূড়ান্তভাবে বলে দেওয়া উচিত যে, তাদের আর দরকার নেই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে শিক্ষাবিদেরা ঢাকায় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন না দেওয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এবার সেই অনুরোধও রক্ষা করা হয়নি।
ঢাকায় অনুমোদন পাওয়া দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের উদ্যোক্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জামিল হাবিব নামের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন পাওয়া ঠিকানা হলো এফ/ ১৫, প্রগতি সরণি, বাড্ডা, গুলশান। অপর বিশ্ববিদ্যালয়টি হলো কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এর উদ্যোক্তা চৌধুরী নাফিজ সরাফত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ৩৮৭, তেজগাঁও শিল্প এলাকা।
কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এটিকে সত্যিকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চান। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও তাঁর স্ত্রী রয়েছেন।
মানিকগঞ্জের ৭৩/৩, নারাঙ্গাই এলাকায় অনুমোদন পাওয়া এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না ও মো. শামসুর রহমান।
চট্টগ্রামে অনুমোদন পেয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, চিটাগাং। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা মুহাম্মদ ওসমান নামে এক ব্যক্তি। এ ছাড়া খুলনায় অনুমোদন পেয়েছে নর্দান ইউনিভার্সিটি। ঢাকায় অবস্থিত নর্দান ইউনিভার্সিটির শাখা ক্যাম্পাস ছিল খুলনায়। অবৈধ এই শাখা ক্যাম্পাস নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা ছিল। মূলত এই শাখাটিকে ঘিরেই নাম বদল করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে। এর উদ্যোক্তা হিসেবে মো. আনছার আলী থাকলেও মূলত নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকেরাই নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় রয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
নতুন ছয়টিসহ দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ৯১ (একটি মামলা করে চলছে)। আরও কয়েকটির অনুমোদন দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। তবে ঢালাওভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও বিরক্ত।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁদের বলার কিছুই নেই।
নতুন ছয়টিসহ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ২০১২ সালে ১৬টি, ২০১৩ সালে ১০টি, ২০১৪ সালে দুটি ও ২০১৫ সালে অনুমোদন পেয়েছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। অভিযোগ আছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। প্রায় সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনেই হয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, না হয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী জড়িত।
এসব ব্যক্তির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংসদ নজরুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম, এ এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আহমেদ চৌধুরী, সরকারদলীয় সাংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সাবেক সদস্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার, সাংসদ আবদুল মতিন খসরু, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকসহ আরও কয়েকজন নেতা ও ব্যবসায়ী বিভিন্ন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পান। এ ছাড়া পুরোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদারসহ কয়েকজন যুক্ত হন।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও দলীয় বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। এমনকি জোট সরকারের শেষ কর্মদিবসেও একটি বেসরকারি সংস্থাকে ঢাকায় এবং একজন মন্ত্রীকে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.